[vc_row][vc_column css=”.vc_custom_1596871563159{margin-bottom: 0px !important;}”][vc_column_text css=”.vc_custom_1596874329023{padding-top: -30px !important;}”]

শিরোনাম
দীঘিনালায় যৌথবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ কর্মী আটকবান্দরবানে রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবন জোড়পূর্বক দখলের অভিযোগবান্দরবানের থানচিতে ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশমানিকছড়িতে চাঁদাবাজি করতে এসে জনতার হাতে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকবরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগরাঙ্গামাটির লংগদুতে নৌকার কিছু নেতাকর্মী এখন ট্রাকে উঠে গেছেকাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টাসড়ক দুর্ঘটনায় কাপ্তাই বিএফআইডিসি এলপিসি শাখার কর্মচারী নিহতমানিকছড়ির নবাগত ইউএনও’র সাথে বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা বিনিময়খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
[/vc_column_text][/vc_column][/vc_row]

“আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যার বিচার চাই”

১৬০

॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥

এখন থেকে ৩৩ বছর আগের কথা। ৩৩ বছর পরে আবার ফিরে আসছে রাক্ষুসে সেই রক্তাক্ত কালো দিন ০৪ জুন। তখন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ভয়ানক অশান্ত পরিস্থিতি। পাহাড়ের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। এই অন্য রকম থমথমে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন হওয়ার মাত্র ১১ (এগার) দিন আগের ঘটনা। পাহাড়ের ইতিহাসে ১৯৮৯ সালের ০৪ জুন রবিবার সন্ধ্যা ৭.৩০ ঘটিকার সময় এক জঘন্যতম কালো অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে। সেই রাক্ষুসে কালো দিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে, সাহসী ভূমিকা গ্রহণের জন্য যে, মহান বীর সেনানী অকালে অনাকাঙ্কিত হত্যার শিকার হয়েছিলেন তাঁর নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ। সাম্যবাদী এই মানুষটি অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণ কেন্দ্র জেলা সদরের পুরান রাঙ্গামাটির ১১৫নং বালুখালী মৌজার পাকুরিয়া নালা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১০ অক্টোবর ১৯৪৯ইং সনে জন্ম গ্রহণ করেন। (পুরান রাঙ্গামাটি ডিসি বাংলোর পিছনের কাপ্তাই হৃদের জলমগ্ন এলাকা) বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম বাঙালি হেডম্যান ও চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল হামিদ ও সোহাগ খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তা যাকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেন, তিনি জন্ম থেকে একটু ব্যতিক্রমী হিসেবে বেড়ে উঠেন। তাই তো সুশিক্ষিত মানবতাবাদী এই মানুষটি জ্ঞান বুদ্ধি, নম্রতা, সততা, সত্যবাদিতা, ভদ্রতা ও সাহসিকতায় ছিলেন অনন্য। ছোটবেলা থেকেই দেশ ও দশের জন্য একটু কল্যাণ করতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করতেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পদার্পণ করতেই দেশ মাতৃকার টানে ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন তিনি।

এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে মরুভূমিতে রূপান্তর করতে পোড়া মাটির নীতিতে হায়নারা যখন উম্মাদ হয়ে বাঙালি নিধনে ব্যস্ত। তখন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে সিংহের মতো গর্জে উঠে দুশমনদের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি স্বাধীনতার এক সাহসী লড়াকু সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ইং সনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি একজন চৌকষ ছাত্রনেতা, সু-বক্তা এবং সংগঠক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অতঃপর প্রেসের ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও এ পার্বত্য চট্টগ্রামের কঠিন বাস্তবতা, গরীব দুঃখী মানুষের দুঃখ-বেদনার প্রকৃত সত্য, দেশ ও দশের সামনে তুলে ধরে আশু সমাধানের লক্ষে সাপ্তাহিক পার্বত্য বার্তা নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। তিনি আমৃত্যু এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। নিজে সুশিক্ষিত ছিলেন বলেই এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষকে শিক্ষার আলোতে আলোকিত করার মানসে রাঙামাটি পৌর মহাবিদ্যালয় (যা বর্তমানে রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ প্রতিষ্ঠানে সম্মানের সাথে আমৃত্যু অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রচার প্রসার ও শিল্প কারখানা গড়ে তুলে এবং উদ্যোক্তাদের সার্বিক কল্যাণ আর উন্নয়নের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং আমৃত্যু সভাপতি হিসেবে এ সজ্জন মানবতাবাদী নেতা দায়িত্বরত ছিলেন। রাঙ্গামাটিতে এমন কোনও অনুষ্ঠান আর এমন কোনও প্রতিষ্ঠান নাই যে, যেখানে এই বীর সেনানীর হাতের পরশ নেই। রাঙ্গামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক, সন্ধ্যানী জেনার্স ক্লাব এর সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি রাঙ্গামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি নাসিব রাঙ্গামাটি জেলা শাখা, সিনেট সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, রাঙ্গামাটি জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সহ-সভাপতি রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাব, সভাপতি, বনরূপা ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, সাধারণ সম্পাদক, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা ঠিকাদার কল্যাণ সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের কর্ণধার ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি আজীবন বাম পন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত এবং আমৃত্যু বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মূলত বিচিত্র উদ্যমের বর্ণাঢ্য জীবনে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী এক মহান মানুষের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ। স্বল্প পরিসরে ক্ষুদ্র কলামে তার গুণকীর্তন লিখে শেষ করা কখনো সম্ভব পর নয়।

তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মজলুম মানুষের পক্ষে সাম্যবাদী মুক্ত মনের মানবতাবাদী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী আপোষহীন মানুষের অন্যতম একজন। আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া তাঁর জীবনের একটি অন্যতম দৃষ্টান্তকারী সাহসী ঘটনা এখানে ক্ষুদ্র আকারে আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তিনি শহীদ হবার মাত্র দেড় মাস আগের ঘটনা। ১৭ এপ্রিল ১৯৮৯ইং তারিখ দিবাগত রাতে একটি সামান্য ঘটনার প্রেক্ষিতে রাঙ্গামাটির পুলিশ প্রশাসনের মারমুখী আক্রমণে রিজার্ভ বাজারের সাধারণ মানুষের আহাজারি চলে সারারাত। পরদিন সকালে শহরের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা পুলিশ সুপার এর কার্যালয় পেরিয়ে গেল। এই কার্যালয়ের ভেতর থেকে হঠাৎ গুলি করা হলো। গুলিবিদ্ধ হল রাঙ্গামাটি কলেজের ছাত্র আজাদ। গুলিবিদ্ধ আজাদের আত্ম-চিৎকারে সেইদিন রাঙ্গামাটির আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। রক্তের বন্যায় রাজপথ রঞ্জিত হলো। গুলির শব্দে পুলিশের এ্যাকশনে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ। সেদিন গগনবিদারী আর্তনাদ করে অশ্বগতিতে এগিয়ে এসে এই বীর সেনানী আব্দুল রশীদ বললেন, ওরে পুলিশ! আমাকে গুলি কর! আজাদকে নয়। সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাবা না। যদি মারতে হয় আমাকে মার। আজ নিজেকে ধন্য মনে হয়, একজন মহান নেতার সংস্পর্শে ছিলাম বলে। আজাদের পায়ে গুলি লেগে সে আজো পঙ্গুত্ব বহন করছে। আজাদ যে আজো বেঁচে আছে, সে কৃতিত্ব কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদের। শুধু এটি নয়, কঠিন দুঃসময়ে গণ মানুষের কাতারে এগিয়ে এসেছেন এ জননেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ। লাশ আর বারুদের গন্ধে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। তখন তিনি শান্তির অগ্রদূত হয়ে জীবন মরণপণ করে এগিয়ে এসেছেন। পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠির সার্বিক কল্যাণ মাথায় রেখে অস্থিতিশীল এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এ ভূমিকার কারণে কুচক্রী মহলের স্বার্থহানি হওয়ার প্রেক্ষিতে ওদের চোখের বালিতে পরিণত হন তিনি। যিনি সারাজীবন সত্য-ন্যায় আর সুন্দরের পথে চলেছেন, তাঁকে তামাম দুনিয়ার দুষ্টু গ্রহগুলো কি অসুন্দরের পক্ষে নিয়ে যেতে পারেন? তা কি সম্ভব? না সম্ভব নয়, কারণ আমাদের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ কাপুরুষ নন। তিনি সত্যিই এই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক অনন্য বীর পুরুষ।

স্বার্থান্বেষীদের কলের পুতুলের মতো তিনি হতে পারেনি। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যায় আবদারের কাছে তিনি মাথা নত না করায়, এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল রশীদ এর মৃত্যুদন্ডের রায় নির্ধারণ পূর্বক, সুযোগ বুঝে রায় কার্যকরের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে ওরা। এ কথা তিনি জানতেন বিধায় সর্তকতার সাথে চলাফেরা করতেন। তাই তো সন্ধ্যার পর অফিস করা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক পূর্বে থেকেই। কিন্তু বরাতে যার নির্মম মৃত্যু লিখা! তিনি বেঁচে থাকেন কি করে? তা না হলে, ঐ দিন অসময়ে পত্রিকা অফিসে আসবেন কেন? কাগজ-কলম হাতে জীবনের শেষ রিপোর্ট লিখতে লিখতে হঠাৎ সিনেমার কায়দায় হন্তারক এসে জানালা দিয়ে গুলি করে। পাহাড়ের কান্ডারির মাথা থেকে রক্তের নদী বয়ে যায়। অতপরঃ প্রথমে রাঙ্গামাটির সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকগণ অপরাগতা প্রকাশ করলে চট্টগ্রাম হাসপাতালে নেয়ার পথে পৌর এলাকা পেরিয়ে মানিকছড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ০৪ জুন ১৯৮৯ইং তারিখ থেকে এ দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক কলংকময় দিন। মৃত্যুবার্ষিকী এলে স্মৃতিসৌধে ফুল, স্মরণসভা কিংবা মানববন্ধন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল রশীদ হত্যার বিচারের দাবিতে আহাজারি শুনি বছরের পর বছর। এভাবে দিন যায়, বছর যায়, মৃত্যু বার্ষিকী ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু রশীদ হত্যার বিচার আদৌ হবে কি না? কিংবা কবে, কখন হবে আমাদের জানা নেই। এটাই রশীদ হত্যার বিচারের বর্তমান বাস্তবতা। তবুও আশায় বুক বেঁধে অগ্রসর হতে চাই। কারণ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এ বাংলার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারই পারে জনগণের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন মামলা যখন পুনরুজ্জীবিত করে সুবিচার নিশ্চিত করেছেন, তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদের হত্যা মামলাটিও পুনরুজ্জীবিত করা এখন সময়ের দাবী।

এখানকার কঠিন নিমর্ম বাস্তবতার আলোকে কুচক্রী মহলের সকল ষড়যন্ত্র ভেদ করে মিথ্যার আবরণে ঢাকা হত্যার প্রকৃত সত্যের সন্ধানে সবাইকে এক যোগে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই শনির কুচক্র থেকে মুক্তি পাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ হত্যার বিচার। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল রশীদ এর হত্যার বিচারসহ এই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যার বিচার চাই। পরিশেষে মহান এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ৩৩তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে চিরঞ্জীব এ মহান নেতার স্মৃতির প্রতি বিনত মস্তকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও অজস্র লাল সালাম। এই চিরঞ্জীব বীর সেনানীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহ্ পাক তাঁকে জান্নাত দান করুন-আমিন।

লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)

কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।