আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মারমা সম্প্রদায়ের জীবনধারা
॥ পাহাড়ের সময় ডেস্ক ॥
ভারত মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ র্পূবাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশর এক দশমাংশ ভূমি পার্বত্য চট্রগ্রাম। এককালে অধিক তুলা উৎপাদন হত বলে বৃহত্তর এই পার্বত্য চট্রগ্রামের পরিচিতি ছিল কার্পাস মহল নামে। ১৮৬০ সালে সর্ব প্রথম পৃথক জেলায় রূপান্তরিত হয় এটি। অতঃপর ১৯৮০ সালে বান্দরবান এবং পরে খাগড়াছড়িকে জেলায় উন্নীত করে রাঙ্গামাটিসহ তিনটি জেলায় বিভক্ত করা হয় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামকে।
পাহাড়ি অঞ্চলে মারমা জনগোষ্ঠীঃ
পার্বত্য জেলা সমূহে বসবাসরত আদিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস অতি সুপ্রাচিনকালের। ইতিহাসের মূল উপাত্ত খুঁজে পাওয়া না গেলেও খ্রিষ্টিয় ৫ম শতাব্দীর দিক থেকে আদিবাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে আসছে ১০ ভাষাভাষি ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। বৈচিত্র এই জনগোষ্ঠি সমূহের জীবন ও সংস্কৃতি যেমন চিরাচরিত ঐতিহ্যে লালিত তেমনি বর্ণিল ও নান্দনিক। তাদের বর্ণিল সামাজিক ও সংস্কৃতি জীবন ধারা খুবই সুন্দর ও দর্শনীয়। এ সমস্ত সামাজিক ও সংস্কৃতির জীবন ধারা জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটি সূত্রে চির গাথা।
১০ ভাষাভাষি ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠিঃ
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ১০ ভাষাভাষি ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠি হল চাকমা,মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, চাক, খুমী, পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং। প্রত্যেকটি জাতিরই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে। সংখ্যা গরিষ্ঠতার দিক দিয়ে ক্রমানুসারে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাই প্রধান।
মারমা জনগোষ্ঠি জীবনধারা
পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী সমূহের মধ্যে গরিষ্ঠতার দিক দিয়ে মারমাদের অবস্থান হলো দ্বিতীয়। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মারমাদের বসবাস রয়েছে। এককালে রাজধানী ঢাকাতেও তাদের অধিক বসবাস ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। যার প্রমাণ ঢাকার মগবাজার। সেখানে মারমাদের বসবাস ও ব্যবসা বাণিজ্যে আধিপত্য ছিল বলে মগ বাজারের নামকরণ হয়। বর্তমানে বরিশাল, পটুয়াখালী ও কক্সবাজারের মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে মারমাদের সবচেয়ে বেশি বসবাস রয়েছে বান্দরবানে। অপর দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতেও মারমারা বসবাস করেন। মারমারা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত বলে যানা যায়। তাদের সামাজিক ও সাংস্কতিক জীবন ধারা অতি সু-প্রাচিন, বৈচিত্রপূর্ণ এবং আকর্ষণীয়তা রয়েছে। মারমাদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি, সমাজ ও সামাজিক বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১১ সালে আদম শুমারি অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত মারমাদের জনসংখ্যা ২লাখ ২হাজার ৯৭৪ জন ছিল। বর্তমানে প্রায় পৌনে ৩ লাখ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মারমা সমাজ ব্যবস্থাঃ
মারমা সমাজ নিজেদের মগ বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করে। তাদের মতে মগ বলে কোন জাতি নেই। এটা অন্য জাতির খেতাব বলে যানা যায়। মারমাদের গায়ের রং ফর্সা এবং পায়ের গোড়ালি বড়। বার্মিজদের সাথে তাদের চেহারার মিল রয়েছে। মারমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি। গৌতম বুদ্ধের অনুশাসনই তাদের ধর্মের মূল মন্ত্র। এছাড়া প্রকৃতি পূজারিতেও মারমারা বিশ্বাসী। মারমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান,বুদ্ধ পূর্ণিমা, সাংগ্রাই অন্যতম। মারমাদের মধ্যের গোত্র বিভাগ রয়েছে। গোত্রগুলো সাধারণত পূর্ব পুরুষদেরও বাস স্থানের নামে প্রচলিত। প্রাচীন কাল থেকেই মারমারা পাহাড়ের গায়ে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বর্তমানে মারমাদের শিক্ষিতের হার অনেক। তাদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দেশ বিদেশে চাকরি করছেন। মারমারা ব্যবসা বাণিজ্যেও জড়িত। তবে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি কর্মঠ। চাষ বাস ছাড়াও সংসারের প্রায় কাজ মেয়েদের উপর ন্যস্ত। মারমা সমাজে পুরুষরা অনেকটাই অ-প্রধান। তবে মারমা সম্প্রদায় পিতৃ প্রধান সমাজের মানুষ। মেয়েরা চাষ বাস ছাড়াও কাপড় বুনন ও চুরুট তৈরিতে বেশ পটু। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও মারমারা কাপড় এবং চুরুট বাইরে রফতানি করতে পারে। তবে মেয়ে পুরুষ উভয়ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসে। তবে মেয়েরাই বেশি সাজগোজ পছন্দ করে। মেয়েরা চুলের খোপায় নানা রকমের ফুল ব্যবহার করে। এছাড়া মেয়েরা ও পুরুষ উভয়ে লুঙ্গি ব্যবহার করেন। মেয়েদের পরনের লুঙ্গিগুলো থামিই বলে। মেয়েরা ফুল হাতা ব্লাউজ গায়ে দেয়। এ গুলোকে তারা এনিজ্যি বলে। মেয়েরা বিচিত্র ধরনের পুতির মালা বা কড়ির মালাও ব্যবহার করে। পুরুষরা মাথায় পাগড়ি হিসেবে গৌং বৌং ব্যবহার করেন।
মৃতদেহ সৎকার ও পরোপকারিঃ
মারমারা অত্যন্ত পরোপকারি এবং অতিথি পরায়ন হন। তারা পথিকদের জন্য রাস্তার পাশে ছোট্ট মাচাং ঘরে খাবার পানি ভর্তি কলসি রেখে দেয়। মারমা ভাষায় একে রিফংজাং এবং বাংলা ভাষায় জল টঙ্গি বলা হয়। তাদের ঘরে নবজাতকের জন্ম হলে বর্ণাদ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা আনন্দ ফুর্তি করে। বৌদ্ধ সমাজ নিয়ম অনুয়ায়ী তারা মৃতদেহ সৎকার করেন এবং ধর্মীয় শাসন অনুযায়ী পরলোকগত ব্যক্তির সৎগতি কামনায় সংঘ দান, অষ্টপরিস্কার দান অনুষ্ঠান করেন।