॥ কবির হোসেন, কাপ্তাই ॥
কৃষি নির্ভর অঞ্চল হিসেবে বেশ পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি। এ অঞ্চলে শিল্প, কারখানা কম বলে ভৌগোলিক দিক বিবেচনা করে পাহাড়ের মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সমতলের মতো পার্বত্য অঞ্চল কৃষির সাফল্য আনতে পাহাড়ে কৃষকের বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে অবস্থিত রাইখালী পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। এরমধ্যে ২০টি জাত আবিষ্কার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে কেন্দ্রটি। সবচেয়ে বেশি প্রজাতি সংগ্রহের দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে দেশে দ্বিতীয়তম বলা হয়।
জানা যায়, পাহাড়ে চাষ উপযোগী ফসলের জাত এবং অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করাই পাহাড়ী কৃষি গবেষণার মূল কাজ। এ লক্ষে পাহাড়ি এই অঞ্চলে কৃষির উন্নয়নে ১৯৭৬ সালে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নে প্রায় ১০০ একর জমিতে গড়ে উঠে রাইখালী পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
বিভিন্ন ফসল নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালায় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ৬৫ প্রকারের ফল গাছ আছে এই কেন্দ্রে। এর মধ্যে ২৫টি জাত নিয়ে গবেষণা চলছে। সবজির মধ্যে ১০টি জাত নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলমান। ৩৭ প্রকারের শুধু বেল গাছের সংগ্রহ রয়েছে সেন্টারটিতে। সংগ্রহের মধ্যে এমন সব ফলজ বনজ গাছ রয়েছে যা দেশের অন্যান্য গবেষণা সেন্টারেও নেই।
গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গত বছরও বারি জাম-১ এবং চলতি বছর বারি কদবেল -২ নামে একটি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। কদবেলগুলো আকৃতি এত বড় যা দেখতে বেলের মতো। সারাবছরই কদবেল গাছগুলো ফলন দেবে বলেও জানা যায়। এছাড়াও সম্প্রতি উচ্চফলনশীল এবং কসবিহীন বেল নিয়ে কাজ চলছে। বারি মহাপরিচালক বরাবর দ্রুতই এই বিষয়ে প্রস্তাবনা যাবে বলে জানা গেছে। বছরে ২০ হাজারের মতো বিভিন্ন ফসলের চারা বিতরণ করা হয় কেন্দ্র থেকে। পাহাড়ী এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা আসেন বিভিন্ন ফসল সম্পর্কিত জানতে।
প্রতিষ্ঠানটি একাধিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বিভিন্ন গবেষণা সাফল্যের কথা। দীর্ঘ সাত বছরের গবেষণায় বীজমুক্ত (বিচিবিহীন) পেয়ারার নতুন জাত উদ্ভাবন করে সফলতা অর্জন করেছে। উদ্ভাবিত নতুন জাতের এই পেয়ারার নাম দেয়া হয়েছে ‘বারি পেয়ারা-৪’।
এছাড়াও রাইখালী পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবিত সবজির জাত হলো, বারি ঝারশিম-২, বারি ঝারশিম-৩ (খাইস্যা), বারি জ্যাকবিন-১, বারি সীতা লাউ-১, বারি ব্রোকলি-১, বারি চিনাল-১, বারি সীম-৯, বারি সীম-১০ এবং বারি সীম-৪। ফলের জাত হলো- বারি কলা-৩, বারি কলা-৪, বারি কামরাঙ্গা-২, রাবি আম-৮, বারি মিষ্টিলেবু-১, বারি কুল-৪ (বরই), বারি ড্রাগন ফল-১, বারি জলপাই-১, বারি পেয়ারা-৪ জাত এবং বারি জাম-১।
কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, রাইখালী পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে উদ্ভাবিত ফল ও সবজি শুধু এ অঞ্চলেই নয়; দেশের কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। শুধুমাত্র জাত উদ্ভাবনই নয়, মাঠপর্যায়ে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রমে পাহাড়ী অঞ্চলে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাত ব্যবহার করে কৃষকও পাচ্ছেন সুফল। বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনও বাড়ছে বলে জানা গেছে।
রাইখালী পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মো. আলতাফ হোসেন জানান, পাহাড়ের কৃষির উন্নয়নে রাইখালী কৃষি গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২০ টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যার মধ্যে ১০টি ফলের জাত, নয়টি সবজির জাত। আমরা আরও কিছু প্রস্তাবনা পাঠিয়ে রেখেছি। রাইখালীর গবেষণা কার্যক্রম উন্নয়নের জন্য এর চারপাশে একটি সীমানা প্রাচীর দরকারও বলেও জানান তিনি।
রাইখালী এলাকার বাসিন্দা মোঃ চৌমিয়া মারমা জানান, বিচিহীন পেয়ারা চাষাবাদ করছি। ভালই ফলন পেয়েছি। বিভিন্ন পরামর্শের জন্য যখন যাই তখনই সেবা পাই। আমাদের কোন ফসলে কোন সমস্যা হলেই ছুটে যাই কেন্দ্রে।
গবেষণা কেন্দ্র হতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করা কৃষক মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আমি এই গবেষণা কেন্দ্র হতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে আম, বাগান এবং নিচুর চাষ করে সফলতা অর্জন করেছি।
কৃষক আব্দুল জৃলিল জানান, আমিও কৃষি গবেষণা কেন্দ্র হতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে মাল্টা, ড্রাগন এবং আমের চাষ করেছি এবং লাভবান হয়েছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত পরিচালক পবন কুমার চাকমা জানান , রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে তারা নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত জাতগুলো কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছানো কাজটি আমরা করে থাকি।