যত্রতত্র পাথর উত্তলন
পানির উৎস নষ্ট হয়ে থানচিতে বিশুদ্ধ পানির সংকট
॥ চিংথোয়াই অং মার্মা,থানচি ॥
বান্দরবানে থানচি উপজেলার সদরসহ বলিপাড়া, তিন্দু ও রেমাক্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন পাহাড়ী জায়গাতে ঝিড়ি-ঝর্ণা, ছড়াগুলো থেকে অবৈধ ভাবে পাথর আহরণের কারনে পানি শুকিয়ে গেছে। পাহাড়ে বন, ঝিড়ি, ঝর্ণা, ছড়াগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে মানুষের জীবন যাত্রা প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।
এদিকে থানচিবাসীদের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক ঝিড়ি, ঝর্ণা, ছড়াগুলোতে ইতিমধ্যে পানি শুকিয়ে গিয়ে তীব্র বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও জীবন ধারণের উপর চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। ঝিড়িগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির শামুক, ছোট মাছ, ঝিড়ি চিংড়ি ও কাকড়াগুলোও হারিয়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অবৈধ ভাবে পাথর আহরণের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে আইলমারা ঝিড়ি, মাংগই ঝিড়ি, বালু ঝিড়ি, নাইক্ষ্যং ঝিড়ি, শিলা ঝিড়ি, মংগকগ্রী ঝিড়ি, পদ্ম ঝিড়ি, হাব্রু হেডম্যান পাড়া ঝিড়ি, বোডিং পাড়া ঝিড়ি, চমি পাড়া ঝিড়ি, লাকপাইক্ষ্যং ঝিড়ি, চইক্ষ্যং ঝিড়ি, কাইতাং পাড়া ঝিড়ি, কুংলা পাড়া ঝিড়ি, সিংৎলাংপি পাড়া ঝিড়ি, সালেক্যা পাড়া ঝিড়ি ও শেরকর পাড়া ঝিড়িসহ ঝিড়ি শাখা-প্রশাখা আরো ছোট বড় শতাধিক ঝিড়ি। এই সমস্ত ঝিড়ি, ঝর্ণা, ছড়াগুলো থেকে অবৈধ ভাবে পাথর আহরণের পাচার করে পাথর খেয়েও হজম হয় খেকোদের। কিন্তু পাথর উত্তোলন ও পাচার করার কারণে ঝিড়ি, ঝর্ণা, ছড়াগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকটে পানি খেলেও হজম হয়নি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের। চরম ভোগান্তিতে জনজীবন চলছে।
অন্যদিকে কিছু সংখ্যক পার্শ্ববতী চকরিয়া, সাতকানিয়া, আমিরাবাদ, রুমা, লামা ও দোহাজারি এলাকার থেকে অসাধু ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় এলাকার প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী চক্রগুলো সরকারে দলীয় নাম ভাঙ্গিয়ে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে থানচির বিভিন্ন এলাকায় ঝিড়ি, ঝর্ণা, ছড়াগুলো থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে দিবারাত্রি পাথর পাচার কাজে অব্যাহত রেখেছে। স্থানীয়ভাবে পাথর উত্তোলন ও পাচারে বাধা দিলেও লুটেরা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী চক্রগুলো প্রভাবশালী হওয়ায় পাথর পাচার কাজ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। প্রতি বছর অক্টোবর/নভেম্বর মাসেই পাথর আহরণের পর সরবরাহের কাজ শুরু হয়। পাহাড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার কারনে জুমের ধান, তিল, তুলা, মরিচ, মারফাসহ আম, কাজুবাদাম বাগান ফসলের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ বছর অতিরিক্ত গরমের কারনে আম ও কাজুবাদাম খুবই কম হয়েছে। এই নিয়ে থানচি সদর ইউনিয়নের মেম্বার ও টুকটং পাড়া কাজুবাদাম চাষী তিংপাও ম্রো বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর গাছে কাজুবাদাম কম ধরেছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে কাজুবাদাম ফুল ঝড়িয়ে যাওয়ায় ফল ধরছে না, যা ধরেছে তাও সন্তোষজনক নয়।
বলিপাড়া ইউনিয়নের বিদ্যামনি পাড়া কারবারী যাদুরাম ত্রিপুরা বলেন, এবছর আমার আম ও কাজুবাদাম কম ধরেছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে ফুল গুলো শুকিয়ে গিয়ে ফল ধরতে পারছে না। বাগান পরিষ্কার মজুরি বাবদ এখনো অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে। ফলন ভাল না হওয়ায় কিভাবে কি করি কিছুই বুঝতে পারছি না।
পাথর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রগুলো রয়েছে সংঘবদ্ধ একটি শক্তিশালী সমিতি। সমিতির মাধ্যমে দলীয় নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যবসার পরিচালনা করা হয়। লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, রুমা, লামা, বান্দরবান সদর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সহ সরকার দলীয়, বিরোধী দলীয়, সাবেক জনপ্রতিনিধি ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী চক্র বিভিন্ন ঝিড়িগুলোতে পাথর আহরণ অব্যাহত রেখেছে। পাথর উত্তোলন এখন বছরের শেষ মৌসুম হওয়ায় পাথর পাচার করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অসাধু পাথর ব্যবসায়ীরা।
ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর পাথর আহরণকারীদের পাথর জব্দ, পাথর ভাঙ্গা যন্ত্রাংশ পুড়িয়ে নষ্ট ও জড়িমানা করা হলেও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী চক্রগুলো প্রভাবশালী হওয়ায় এখনো পাথর আহরণ ও পাচার কাজে অব্যাহত রেখেছে।
এই নিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থোয়াইহ্লামং মারমা বলেন, আপনারা পাথর ব্যবসায়ীদের বিরূদ্ধে লিখতে থাকেন, সমন্বিত প্রচেষ্টায় কোন একদিন ঠিকই আমরা তাদের থামাতে পারব। থানচিকে বাঁচাতে হবে, থানচি মানুষকে বাঁচাতে হবে, থানচি প্রাকৃতিক সম্পদকে বাঁচাতে হবে, এভাবে চলতে দেয়া যায় না। পাথর আহরণকারীদের বিরূদ্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে কথা বলতে হবে।
এলাকার সচেতন মহলের মন্তব্য, গাছ-পালা কেটে ধ্বংস করা হলেও পূর্নরায় গাছ লাগিয়ে পাহাড়কে বাচাঁনো যায়, কিন্তু ঝিড়ি-ঝর্ণা-ছড়াগুলো পাথর একবার আহরণ করা হয়ে গেলে কোনমতে পূর্নবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।তাছাড়া পাথর আহরণের সময় পাথরগুলোকে ফিটিয়ে টুকড়ো টুকড়ো করার ফলে বাকী পাথরগুলোও মরে গিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। যার ফলে পাহাড়ে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে ফিরিয়ে আনতে হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সাধারণ জনগণদের নিয়ে এর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করাতে হবে। থানচি প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ে হাত থেকে বাঁচাতে পাথর ব্যবসায়ীদের বিরূদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনগণের পক্ষে জোড় দাবী জানানো হয়।