॥ চিংথোয়াই অং মার্মা,থানচি ॥
বান্দরবানের থানছি উপজেলার পাহাড়, ঝিরি থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন এবং বিক্রয় করার কারনে উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় পানি সংকটের পাশাপাশি পরিবেশের চরম ক্ষতি হতে যাচ্ছে। বর্তমানে এ উপজেলার বেশ কিছু প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে এখন পানির সংকট চরম আকার ধারন করছে। স্থানীয় অনেকেই আক্ষেপ করে বলছেন যে সবুজ পাহাড় ঝিরি, ঝর্ণা, পাথর নিয়ে আমাদের অস্থিত্ব এখন সেসবগুলোই হারিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও প্রকৃতি সম্পদ এর উপর ভর করে পাহাড়ে আদীবাসিরা বসবাস করে আসছে । কিন্তু আমাদের সেই প্রকৃতি আর থাকছেনা কিছু অসাধু পাথর ব্যবসায়ীর কারনে।
দেখা যায়, সরকারের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করার জন্য পাহাড়ের বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরাই । এছাড়াও খালের আশপাশগুলোয় যা পাথর ছিল তা গত দু-এক বছরের মধ্যে সবগুলি তুলে নিয়ে গেছে । এখন খালের নোংরা পানিতে স্নান (গোসল) বাসন-পাতিল ধোয়া এবং গহীন জঙ্গলে গিয়ে খাওয়ার পানি নেয়া ছাড়া আর কোন উৎপায়ও নেই বলে জানিয়েছেন লাংরই হেডম্যান পাড়া (বোল্ডিং পাড়া) নিবাসী লেলক ম্রো (৮৫) সাবেক কারবারী তংরুং ম্রো (৭৫) সহ অনেকে । কাইতং পাড়া বাসিন্দা থানচি সদর ইউপি মেম্বার রেংক্লাং ম্রো ৬২,বর্তমান মেম্বার অংপ্রে ম্রো (৫১) বলেন, আমাদের পাড়া ইউনিসেফ প্রাক প্রাথমিক স্কুল ছাড়া ১ম হতে পঞ্চম শ্রেনির স্কুল নেই । ক্লাস ওয়ান হতে পঞ্চম শ্রেনির পর্যন্ত একটি স্কুল ঘর নির্মান ও দুইজন শিক্ষক দেয়ার কথা বলে কয়েক জন পাথর ব্যবসায়ী থানচি বাজার বাসিন্দা মোঃ জসিম উদ্দিন, সাতকানিয়া বাসিন্দা এম এম এমরান মিয়া, রুমা বাসিন্দা চিংসাথোয়াই মারমা (বিপ্লব) পর্দ্দা ঝিড়ি, হাতি ঝিড়ি আগা, কুংহ্লা পাড়া ঝিড়ি হতে পাথর উক্তোলন করেন । কিন্তু দুই বছর অতিক্রম করলেও স্কুল ঘর নির্মান এবং শিক্ষক দিল না । বারবার তাদের বলা হলে সরকারী উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের জন্য এই পাথর নিয়েছেন বলে জানান ।
এদিকে একই খালে লামা উপজেলা ফাইসিাখালী বাসিন্দা কাজী নুরুল আনোয়ার একই কথা বলে চমি পাড়া, হাবরু হেডম্যান পাড়া, বোল্ডিং পাড়া নিচে অংশ, লাকপাইক্ষ্যং পাড়া, টুকটং পাড়া অংশ হতে গত দুই বছর যাবত পাথর উক্তোলন করে কয়েকটি বড় বড় ট্রাকযোগ পরিবহনে নতুন সড়কে ৮ হতে ৯ কিলোমিটার স্থানে স্তুপ করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় করে আসছেন। দুই বছর পার হলেও তাদের কথা দেয়া কোন প্রকার বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন। ঐসব অঞ্চলে বর্তমানে গ্রীষ্ম মৌসুমে, তীব্র পানির অভাবে পরিনত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বান্দরবানে থানচির পানির উৎস এর বিভিন্ন স্থান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করে নিয়ে গেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তাদের প্রয়োজনে পাহাড় ও খাল কেটে রাস্তা নির্মানে প্রতিদিন অর্ধশাতাধিক ট্রাক চলাচল করায় বর্তমানে বিশুদ্ধ পানি ছাড়াও প্রয়োজনীয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। সাংগু নদীর শাখা প্রশাখা পার্দ্দা খাল, রেমাক্রী খালের প্রবাহমান অসংখ্য ঝিড়ি ঝর্নায় আশে পাশে অবস্থানরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠিদের মধ্যে বিশুদ্ধ পানীয় জলে অভাব দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে পর্যটন কেন্দ্র তাজিংডং এর পাশে সিংত্লাপিং বম পাড়া হতে পর্দ্দা ঝিড়ি পানির উৎসবে প্রধান স্থান। সেখান থেকে নিচে আসতে থাকলে প্রথমে পড়ে কুংহ্লা ম্রো পাড়া, কাইতং ম্রো পাড়া, বোডিং পাড়া, লাইপাইক্ষ্যং পাড়া, হাবরু ম্রো পাড়া, চমি ম্রো পাড়া, রুনাজন ত্রিপুরা পাড়া. থাংলং ম্রো পাড়া, অংথোয়াইপ্রু মারমা পাড়াসহ ১৫-১৬টি পাড়া রয়েছে । থানচি নতুন সড়ক হতে কাইতং পাড়া পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার, খাল পথে সিংত্লাপিং পাড়া হতে অংথোয়াইপ্রু মারমা পাড়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার খালে এপার ওপার ও খালে ভিতর রাস্তা তৈরী করে প্রতিদিন অন্তত পক্ষে ১০/১২টি বড় ট্রাক গত ডিসেম্বর ২০২০ সাল হতে এ পর্যন্ত পাথর পরিবহন করে আসছে। ফলে পর্দ্দা ঝিড়ি খালে পানি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিনত হয়েছে। অবশিষ্ট পানির গুলিগোলা ব্যবহারে উপযোগীর নয়। একইভাবে থানচি উপজেলা ২নং তিন্দু, ১নং রেমাক্রী,রুমা উপজেলা রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের অংশ ঙাফাঁখুম, তাজিংডং পর্যটন কেন্দ্র রেমাক্রী খাল উপর প্রকৃতিভাবে গড়ে উঠার ছোট বড় পাথরকে দেখতে প্রতিদিন ভ্রমন পিপাসুরা চলে আসে। রেমাক্রী খালে চর্তুদিক গাছ পাথর না থাকলে ঐসব পর্যটন কেন্দ্রতে ভ্রমন পিপাসুরা ভ্রমনে নিরুসাহী হয়ে যাবে। এবং পর্যটনের উপর নির্ভর পাহাড়ে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব পড়বে ।
আরো খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থানচি উপজেলা ২নং তিন্দু ইউনিয়নে ৭-৮ ৯ নং ওয়ার্ডে ঙাক্ষ্যং খালে উপর আমিয়াখুম,সাতভাইখুম,বেলাখুমসহ ছোট বড় ৭-৮টি পর্যন্ত কেন্দ্র রয়েছে। ঙাক্ষ্যং খালের উপর বিশাল পাথর ও ছোট বড় পাথরগুলি গত মার্চ মাস হতে ভারুদ দিয়ে ভাঁঙ্গতে শুরু করেছে পাথর খেকোরা। ঙাক্ষ্যং খালে মংখয় খিয়াং পাড়া, জিন্না পাড়া, দুঃহ্লা খিয়ান পাড়া, রামদো পাড়া, স্যালোক্যা ত্রিপুরা পাড়া, নিপিউ পাড়া, দলিয়াং হেডম্যান পাড়া, ছোট মধক ক্যমং হেডম্যান পাড়াসহ আশে পাশে থাকা ঝিড়ির ঝর্ণায় পাথর খেকোরা টার্গেট করে রাখা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
বিএনপি নেতা মোঃ জসিম উদ্দিনে মুঠোফোনে বার বার ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। অপর পাথর আহরনকারী এমএম এমরান মিয়া বলেন, আমি ৩-৪ পাড়া কারবারী ও মৌজা হেডম্যানকে নগদ টাকা দিয়ে পাথর ক্রয় করেন বলে জানান। যে পরিমাণ পাথর পাওয়া কথা ছিল তা পাইনি। সবাইকে ম্যানেজ করা হয়েছে বাকি থাকলে তাদেরও করবো।
থানচি উপজেলা পরিষদে সাবেক চেয়ারম্যান ক্যহ্লাচিং মারমা বলেন, এক সময় যোগাযোগ পিছিয়ে থাকা থানচি উপজেলাকে মাননীয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর (উশৈসিং) মহোদয় বান্দরবান জেলা থেকে থানচি উপজেলা পর্যন্ত যোগাযোগের সড়ক, সাংগু সেতু ছাড়া অভ্যন্তরী ভাবে বিভিন্ন জায়গা যাওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নির্মান করে দিয়েছে। যোগাযোগ উন্নত হলেও মানসিক উন্নত হয়নি সরকারি উন্নয়ন কাজে চট্টগ্রাম হতে আমদানি করা (এলসি) উন্নতমানে পাথর ব্যবহারের পরিবহনে কোন বাধা নেই। এক শ্রেনির মুনাফা লোভিরা দরিদ্রদের কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে পাড়ার প্রধান (কারবারী) মৌজা প্রধান (হেডম্যান)দের কে স্বল্প মূল্যে ম্যানেজ করে এই সব করা হয়েছে। ফলে পর্যটন শিল্প ও জৈববিচিত্র ধংসমূখে অদূর ভবিষ্যৎতে পাহাড়ে পাথর,গাছ, প্রকৃতিভাবে গড়ে উঠা জৈব বিচিত্র প্রাকৃতি খনিজ সম্পদগুলি বিলুপ্ত হয়ে চিড়িয়াখানা ছাড়া খুজে পাওয়ার কঠিন হবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন থানচি শাখা সাধারণ সম্পাদক কবি উমংসিং মারমা বলেন, কারবারী হেডম্যানরা সজাগ থাকলে স্বল্পমূল্যে পাথর বিক্রি না করলে পাথর খেকোরা কোন সময় পাথর উক্তোলন করতে পারবে না। স্থানীয় প্রশাসন হেডম্যান কারবারীদের নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে এবং কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা করতে হবে বলে মত দিলেন তিনি। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর (উশৈসিং) এর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসীরা।