হালদার উজান মানিকছড়িতে
তামাকের স্থলে সবুজ শাক-সবজি,পাল্টে গেছে হালদা পাড়ের চিত্র
॥ মোঃ ইসমাইল হোসেন, মানিকছড়ি ॥
কয়েক বছর আগেও খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠ জুড়ে ছিল তামাকের দাপট। এশিয়া মহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। হালদা চরের উজান মানিকছড়িতে বিগত সময়ে অবাধে তামাক চাষাবাদ করা হলেও সম্প্রতিকালে তামাক আবাদস্থলে শাক-সবজি ও ফল-ফলাদি’র চাষাবাদ শুরু করেছে স্থানীয় কৃষকরা। এতে পাল্টে গেছে হালদা পাড়ের চিত্র। হালদা ফিরে পাচ্ছে তার হারানো ঐতিহ্য। যেখানে তামাকের বিষাক্ত বর্জ্যে ইতোপূর্বে দূষিত হতো পানি, ব্যহত হতো মাছের অবাধ চলাচল ও প্রজনন কার্যক্রম। হালদা নদীর গবেষকদের গবেষণায় হালদা নদীর বেহাল দশায় উঠে আসে দশটি কারণ। যার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো হালদার উজানে তামাক চাষ। যার ফলে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
হালদা নদী আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। সরকার এটিকে ‘বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে । যার ফলে হালদার পরিবেশ উন্নয়নে হালদাপাড় (চর) তামাকচাষ বিকল্প জীবিকায়ণে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বিকল্প চাষাবাদে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর’র পাশাপাশি ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ করছে পল্লী কর্ম-সহায়তা ফাউন্ডেশন(পিকেএসএফ)। যাতে অর্থায়ণ করছে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হালদা চর এলাকার যোগ্যাছোলা, গোরখানা, ছদুরখীল, তুলাবিলের শতাধিক কৃষক তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে উন্নত জাতের ফল-ফলাদি রামবুটান, আম, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, মাল্টা, পেঁপে, ড্রাগন, লিচু’র চারা সরবরাহ ও শাক-সবজি’র বীজ, সার-ওষুধ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা বিষয়ে কাজ করছে কৃষি, মৎস্য, প্রাণী সম্পাদ বিভাগ ও পিকেএসএফ। এতে করে সম্প্রতিকালে পাল্টে গেছে হালদাপাড়ের পরিবেশ। দৃশ্যমান হচ্ছে সবুজ শাক-সবজি ভরা ফসলের সমারোহ। ধীরে ধীরে হালদা ফিরে পাবে তার মৎস্য প্রাণীর অভয়ারণ্য এমনটাই প্রত্যাশা মৎস্য বিশেষজ্ঞদের।
আছাদতলী এলাকার কৃষক মোঃ মুছা মিয়া জানান, আছাদতলী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় হালদার পাড়ের বিস্তীর্ণ জমিতে শুধু তামাকের চাষ হতো। তামাক ছাড়া ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল হবে না বলে সবার ধারণা ছিল। তাই সারা বছর জমিতে তামাক দেখা যেত। তামাক চাষে লাভ বেশি ভাবা হলেও, এটি নিজের এবং পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিশেষ করে হালদা নদীর ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা তামাক ছেড়ে সবজি চাষ করছি।
তুলাবিল এলাকর কৃষক ছালাউদ্দিন বলেন, এক সময়ে এই এলাকার মানুষ হালদার গুরুত্ব ও পরিবেশের কথা চিন্তা না করেই তামাক চাষাবাদ করতো কিন্তু বর্তমানে মানুষ অনেক সচেতন হওয়ায় তামাক ছেড়ে বিকল্পজীকিকায়নের লক্ষে শাক-সবজি ও ফল-ফলাদি চাষাবাদে ঝুঁকছে কৃষক।
আইডিএফ’র হালদা প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ সজীব হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, এশিয়া মহাদেশের অমূল্য সম্পদের অন্যতম এবং একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র আমাদের ‘হালদা নদী’। যা বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যার ঐতিহ্য রক্ষায় এবং প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন স্বাভাবিক রাখতে হালদা পাড়ের পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। সরকারের পাশাপাশি আমরাও এখানকার শতাধিক তামাক চাষীদের বিকল্প জীবিকায়ণে উন্নত জাতের শাক-সবজি, ফল-ফলাদির বীজ, প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষকদেরকে আধুনিক চাষাবাদে প্রশিক্ষিত করে তুলেছি। আশা করছি অচিরেই হালদা পাড় সবুজ শাক-সবজি ও ফল-ফলাদিকে ভরপূর হবে। এতে হালদা ফিরে পাবে ঐতিহ্য।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল ইসলাম মজুমদার বলেন, তামাক চাষের জমিতে এখানে সবজি চাষের বিপ্লব ঘটেছে। ফসলের বৈচিত্র আনার লক্ষ্যে শাক-সবজির পাশাপাশি উন্নত ফল ও মাছ চাষেও সহযোগিতা করা হচ্ছে। ক্ষতিকর তামাক চাষে কৃষক যেন নিরুৎসাহিত থাকে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে আমাদের মাঠকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামান্না মাহমুদ জানান, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। যেখানে প্রাকৃতিক ভাবেই মাছ অবাধে ডিম দেয় এবং পোনা উৎপাদন হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’র জন্মশত বার্ষিকীতে এটিকে আর্ন্তজাতিক তথা বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এর ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষা করে মৎস্য প্রজননে কাজ করছে সরকার।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার যোগ্যাছোলা, গোরখানা, ছদুরখীল, তুলাবিল এলাকায় তামাকের বিকল্প হিসেবে কৃষকরা আলু, টমেটো, বাঁধাকপি, লাউ, বেগুন, ঢেঁড়স, শসা ইত্যাদি চাষ শুরু করেন। ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকদের মুখে সাফল্যের হাসি ফুটেছে।