পুষ্টিগুণ বেশি হওয়ায় চাপা কলার চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয় বাংলা কলা
রাঙ্গামাটিতে মৌসুমী ফলের বাজার এখন কলার জিম্মায়
॥ শাহ আলম ॥
‘পাহাড়ে মাটিভেদে বিভিন্ন জাতের কলার আবাদ হয়। এ এলাকায় কলা আবাদে কীটনাশক ব্যবহার হয় না বললেই চলে। ‘পাহাড়ে দুই জাতের কলা বেশি দেখা যায়। একটি বাংলা কলা। রাঙ্গামাটির স্থানীয় ভাষায় এর নাম কাত্তলি কলা। অন্যটি চাপা কলা, যার স্থানীয় নাম চম্পা কলা। উঁচু পাহাড়ের মাটিতে জন্মায় বলে এগুলোকে পাহাড়ি কলাও বলা হয়। পুষ্টিগুণ বেশি হওয়ায় চাপা কলার চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয় বাংলা কলা।
রাঙ্গামাটিতে সারা বছরই কলা উৎপাদন হলেও বছরের এই সময়ে কলার উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রাঙামাটির মৌসুমি ফলের খুচরা ও পাইকারি বাজার এখন কলার দখলে। রাঙ্গামাটির বিভিন্ন বাজার এখন কলায় ভরপুর। পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে কলা নিয়ে বোট ভিড়ছে জেলা সদরের বিভিন্ন পয়েন্টে। আড়তদাররা সেই ফল কিনে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এদিকে চাষিরা কলার দাম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাগানিরা। তবে কৃষকরা যাতে ফসল উৎপাদন করে ক্ষতিতে না পরেন সেদিকে খেয়াল রেখে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা কথা ভাবছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
এদিকে বিভিন্ন জায়গায় শুষ্ক বাড়ানোর ফলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও খরচ বেড়েছে বলে জানালেন পাইকাররা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ জেলার ১১ হাজার ৭৭৫ হেক্টর এলাকায় কলার আবাদ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টন। গত অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ২৪৫ টন। আবাদকৃত এলাকা ছিল ১১ হাজার ৫৫৭ হেক্টর।
রাঙ্গামাটি জেলা সদর, বরকল, বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর, লংগদু, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, কাউখালী, বাঘাইছড়ি উপজেলা ও সাজেক ইউনিয়নে কলা চাষের খ্যাতি অনেক। সারা বছর এসব উপজেলায় বাংলা, আনাজি, সবরি, চাম্পা, বরি, সাগর, সূর্যমুখী ও নেপালি কলার বাম্পার ফলন হয়। এসব পাহাড়ি কলা প্রত্যন্ত উপজেলা থেকে লঞ্চ ও ক্যান্ট্রি বোটে করে নিয়ে আসা হয় রাঙ্গামাটি শহরে। পরে জিপ, ট্রাক, পিকআপে বোঝাই করে জেলা শহর ও চট্টগ্রামসহ বাইরে নিয়ে যান পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সাপ্তাহিক কলার হাট বসে রাঙামাটিতে। প্রতি হাটে বিক্রির জন্য কলা নিয়ে যান রাঙ্গামাটি সদরের কুতুবছড়ি, বন্দুকভাঙ্গা, বালুখালী, সাপছড়ি, কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া, নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট, ঘিলাছড়ি, নানিয়ারচর, সাবেক্ষ্যং এবং খাগড়াছড়ি মহালছড়ি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের কলা চাষি। এসব কলার ছড়ি পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা। এসব কলার চাহিদা সমতলে বেশি। সাপ্তাহিক হাটের দিন বেচাকেনা হয় লাখ লাখ টাকার কলা।
কলা বাগানি মঙ্গল কুমার চাকমা জানান, গত বছর কলার ভালো দাম পেলেও এবছর ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো মৌসুমে এবার প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। যে কলার দাম ৩০০ টাকা করে আর পাইকাররা দাম দিচ্ছে ২০০ টাকা করে। লস দিয়ে কি বিক্রি করবো এভাবে?
আরেক কলা চাষী সুরেশ চাকমা জানান, এবছর বাগান করতে যে খরচ হয়েছে তা এখনো উঠেনি এবং বাগানে বেশি কলাও নেই। চট্টগ্রাম, ঢাকায় কলার দাম থাকলেও আমরা দাম পাইনা। পাইকাররা বেশি দামে কিনতে চায়না। সবাই একই দাম বলে। এবছর সামন্য লস হয়েছে কলায়।
কলা বাগানীরা হতাশ জানিয়ে নিরন চাকমা বলেন, গত বছর একই বাগন থেকে ৪ লক্ষ টাকার কলা বিক্রি করলেও এবছর প্রায় ৩ লক্ষ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। এবছর আবহওয়া ভালো থাকায় ফলও ভালো হয়েছে। তবে তেমন দাম পাচ্ছি না।
চট্টগ্রামের ফল ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, কলার দাম কম কারণ বিভিন্ন জায়গায় শুল্ক টাকা বৃদ্ধি হওয়ায় গাড়ি প্রতি খরচ বেড়েছে কয়েগুন। এভাবে বেশি দামে ফল কিনে লাভ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
জেলা শহরের বনরূপা বাজারের সমতাঘাট কলাহাটে কুমিল্লা থেকে আসা ব্যবসায়ী মোঃ জামাল (৪৫) জানান, সারা বছর তিনি রাঙ্গামাটি থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্ল¬ায় কলা নিয়ে যান। সমতল এলাকায় এসব পাহাড়ি কলার চাহিদা বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর কলার দাম বাড়ে। এ বছরও বেড়েছে। প্রতি ছড়া (কমপক্ষে ১০০ পিস) কলা মানভেদে ১০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনেছি। কিছু কিছু এলাকার কলার ছড়া এত বড় হয়, সেগুলো ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় কিনতে হয়।’
চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যবসায়ী রফিক উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘সমতল এলাকার কলা আর পাহাড়ের কলার মধ্যে পার্থক্য অনেক। রাঙ্গামাটি থেকে কলা নিয়ে বাজারে বসে থাকতে হয় না। এগুলো সবাই লুফে নেয়।’
রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক(ভারপ্রাপ্ত) কৃষ্ণপ্রসাদ মল্লিক বলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশগত কারণে পাহাড় কলা চাষের উপযোগী। পাহাড়ে এখন আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিতে কলার চাষ হচ্ছে। তাই কলার উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু কলা সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। হিমাগার স্থাপনের মাধ্যমে কলা চাষের সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে পরিচিতি পাবে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। আমরা চেষ্টা করছি একটি কৃষি বাজার সৃষ্টি করার জন্য যেখানে বাগানীরা সরাসারি ফল নিয়ে আসবেন এবং চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ সারাদেশের পাইকরাররা ফল করতে পারবেন। তাহলে বাগানীরা ফলের ভালো দাম পাবে আশা করছি।