[vc_row][vc_column css=”.vc_custom_1596871563159{margin-bottom: 0px !important;}”][vc_column_text css=”.vc_custom_1596874329023{padding-top: -30px !important;}”]
শিরোনাম
দীঘিনালায় যৌথবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ কর্মী আটকবান্দরবানে রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবন জোড়পূর্বক দখলের অভিযোগবান্দরবানের থানচিতে ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশমানিকছড়িতে চাঁদাবাজি করতে এসে জনতার হাতে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকবরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগরাঙ্গামাটির লংগদুতে নৌকার কিছু নেতাকর্মী এখন ট্রাকে উঠে গেছেকাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টাসড়ক দুর্ঘটনায় কাপ্তাই বিএফআইডিসি এলপিসি শাখার কর্মচারী নিহতমানিকছড়ির নবাগত ইউএনও’র সাথে বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা বিনিময়খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
॥ অনির্বাণ বড়ুয়া ॥
একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে বাঙালি জাতি আনন্দে আত্মহারা হলেও সেই আনন্দ পূর্ণতা লাভ করেনি। বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ বাংলার মানুষ তখনো পায়নি। বিজয়োল্লাসের মাঝেও সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মন আচ্ছন্ন ছিল এক করুণ বেদনায়। সেই বেদনার কারণ ছিল আনন্দের দিনে স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের রূপকার, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এঁর অনুপস্থিতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির বীজমন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ-উজ্জীবিত-উদীপ্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যে মহান নেতার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন আর অপরিসীম ত্যাগে অর্জিত হলো আমাদের স্বাধীনতা, বিজয়ের সেই সূর্যসারথি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া কি স্বাধীনতা ও বিজয়ের আনন্দ অর্থবহ হতে পারে ? না, তাঁকে ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা মূল্যহীন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বন্দী রেখে বাঙালির স্বাধীনতা মূল্যহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বন্দী রেখে বাঙালির স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ-বিজয়ের আনন্দ ম্লান।
পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। সবার কন্ঠে এক দাবি-আমাদের নেতা স্বাধীনতার স্থপতিকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ, মুক্তযোদ্ধা ও বিশ^বাসী একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠলো। চারিদিক থেকে একই কন্ঠে ধ্বনিত হলো- বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখার কোনো অধিকার নেই পাকিস্তানের। যুদ্ধফেরত মুক্তিবাহিনী উদাত্ত কণ্ঠে অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির দাবি জানানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত দ্রুত মুক্তি এবং নির্বাচিত জনপ্রতিধিদের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে ইয়াহিয়া খানের বরাবরে আবেদন করেছিলেন।
বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার জনগণের দাবি ও নেতৃবৃন্দের চাপে শেষ পর্যন্ত জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের একুশ দিন পর ভুট্টো শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিরা জানতো না তাদের মুক্তিদাতা ও অবিসংবাদিত নেতা মৃত না জীবিত। অনুপস্থিত ছিলেন বলেই শেখ মুজিবুর রহমান আরও বেশি করে বিদ্যমান ছিলেন সবার মনে। তারা লড়েছিল তাঁর নাম উচ্চারণ করে, মৃত্যুবরণও করেছিল তাঁর নাম উচ্চারণ করে। কারাগারে বন্দী থেকেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নামেই পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্য সমগ্র বিশে^র মানুষ উৎকণ্ঠিত ছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুক্তি না দিয়ে আর কোনো উপায় ছিল না পাকিস্তানী শাসকদের। তখনও জানতেন না, তিনি হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রধান। আত্মবিশ^াস এবং জনগণের প্রতি অশেষ আস্থাই ছিল তাঁর একমাত্র সম্বল। ৮ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ কমেট বিমানটি তাঁকে নিয়ে করাচি ত্যাগ করে। মধ্যরাতের পরপর শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানের কাছে নিয়ে এলেন ভুট্টো।
বিমানে আরোহণ করে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানালেন ভুট্টো। তাঁরা একত্রে বিমানে উঠলে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। দুই নেতা উষ্ণভাবে করমর্দন করলেন। বোয়িং-৭০৭ বিমানটি লন্ডনের পথে যাত্রা করল। বঙ্গবন্ধুকে বিমানে পাকিস্তানের বাইরে নিয়ে আসেন এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী। তাঁকে সামরিক জেট বিমানে উঠিয়ে দিয়ে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন।’ ইথারে ছড়িয়ে পড়া মাত্রই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের চেয়েও বিপুল আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালি ও বিজয়ের মুক্তিকামী সকল মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী পিআইএ’র বিমানটি ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সকাল সাড়ে ছয়টায় লন্ডন হীথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছে। এর আগে বিমানপাইলটের মাধ্যমে লন্ডনে রেডিওবার্তা পাঠানো হয়েছিল। এর সূত্র ধরে সেদিন প্রত্যুষে ব্রিটিশ ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু লন্ডন যাবার বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের তদানীন্তন উপপ্রতিনিধি রেজাউল করিম হলেন সেই ভাগ্যবান বাঙালি কর্মকর্তা যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে পেরেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত গাড়ি ছেড়ে বঙ্গবন্ধু রেজাউল করিমের ব্যক্তিগত গাড়িতে গিয়ে বসলেন। রেজাউল করিম নিজে গাড়ি চালিয়ে হীথ্রো বিমানবন্দর থেকে ব্রিটিশ সরকারের অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ক্ল্যারিজেস হোটেল নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করেন রেজাউল করিম।
লন্ডনে একদিনের অবস্থানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ, বিরোধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসন এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর মুক্তির সংবাদ বিবিসি রেডিওতে প্রচার হওয়ার পর ক্ল্যারিজেস হোটেলে শত শত মানুষ জমায়েত হতে শুরু করে। লন্ডনের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম আগ্রহ সহকারে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে অবস্থান প্রত্যক্ষ করে। ক্ল্যারিজেস হোটেলের গেটের সামনে সহস্র মানুষকে সামাল দিতে পুলিশ-চৌকি বসাতে হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে। সেখানে সমবেতদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু গত নয় মাসের কথা শুনলেন। ইতিমধ্যে ফোনে কথা বললেন দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ফোন করলেন ঢাকার সহকর্মীদেরকে। পরে বাসায় কথা বললেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি লন্ডনে ছুটে এলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। ১০ ডাউনিং স্ট্রীটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এঁর সঙ্গে এক ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম শক্তি হিসেবে ব্রিটেনের স্বীকৃতি প্রদানের প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। মি. হীথ শেখ মুজিবুর রহমানকে অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে স্পষ্ট করেন-বাংলাদেশের প্রতি ব্রিটেনের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ব্রিটেন অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। পাকিস্তানের কারাগারে যখন তিনি ফাঁসি কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তখন তাঁর জীবন রক্ষার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বঙ্গবন্ধু এডওয়ার্ড হীথকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। ক্ল্যারিজেস হোটেলে মি. হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩০ মিনিটের এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। কমনওয়েলথ সেক্রেটারি-জেনারেল মি. আরনল্ড স্মিথও ক্ল্যারিজেস হোটেলে শেখ মুজিবুর রহমান-এঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর ৪০০ জন সাংবাদিকের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেেেশর মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহায়তাকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আমাদের বাংলাদেশের মহান রূপকার।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দেশে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রাজকীয় কমেট বিমানে ঢাকার পথে রওয়ানা হন। সেদিন হীথ্রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানাবার জন্য উপস্থিত বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আব্দুল মান্নান ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী। বিমানে জ¦ালানী তেল নেওয়ার জন্য সাইপ্রাসে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি করতে হয়। এই সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে বঙ্গবন্ধুকে সাইপ্রাসে স্বাগত জানান সে-দেশের রাষ্ট্রপতি ম্যাকারিয়াস। ১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লী পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। নয়াদিল্লীতে তাঁর সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি হয়েছিল। নয়াদিল্লীতে এসে পৌঁছুলে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয় বঙ্গবন্ধুকে। বিমান থেকে অবতরণের সময় ‘শেখ মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ’ ও ‘মুজিব দীর্ঘজীবী হোন’ স্লোগান দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়। দিল্লীর লাখো জনতা, ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, সেনা-নৌ-বিমানবাহিনীর প্রধানগণ শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বৈদেশিক কূটনীতিকবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানান। প্রায় কালো-ধূসর স্যুট ও কালো ওভারকোট পরিহিত শেখ মুজিব বিমানে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। শীতল মৃদুমন্দ সমীরণ তাঁর মাথার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল। তিনি হাত নেড়ে তাঁকে অভ্যর্থনাজ্ঞাপক উল্লাসধ্বনির জবাব দিচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি যখন বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যখন তাঁকে উষ্ণ স্বাগত জানাচ্ছিলেন তখন ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাঁকে অভিবাদন জানানো হচ্ছিল। শুভেচ্ছা-বিনিময় পর্ব শেষ হলে বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর দেয়া গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন এবং পরে ভিআইপি প্যান্ডেলে যান। সেখানে তাঁর ওপর পুষ্পপাপড়ি বর্ষণ করে সম্মান জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর অভিবাদনমঞ্চে অবস্থান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বেজে ওঠে। এর পর বাজানো হয় ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জনগণ অধিনায়ক জয় হে’। প্যান্ডেলের পাশে দুই দেশের জাতীয় পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ছিল। পুরো এলাকায় মানুষ আর মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য মানুষের কতো ব্যাকুলতা। বাঙালি জাতির জনককে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের লক্ষ্যে আবেগে আপ্লুত জনতা মুহূর্তে মুহূর্তে ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। তাঁকে ভালো করে এক নজর দেখার জন্য ছয়-দরজাবিশিষ্ট মার্সিডিজ বেঞ্জ মোটরগাড়িতে তিনি যখন আরোহণ করেন তখন পাগলপ্রায় জনগণ তাঁর সঙ্গে করর্মদন করার জন্য গাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে সারারাত ধরে প্রস্তুতি চলে। প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে পুষ্পখচিত তোরণ নির্মাণ করা হয়। ‘বাংলাদেশের স্থপতি দীর্ঘজীবী হোন’ এবং ‘বাংলাদেশের মুক্তিদাতা দীর্ঘজীবী হোন’ বাণীসম্বলিত ফেস্টুন রাস্তার পাশে শোভা পাচ্ছিল। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ অসুস্থতার কারণে নয়াদিল্লীতে ছিলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এ যুগের সবচেয়ে বড়ো অহিংস গান্ধীবাদী নেতা বলে আখ্যায়িত করে তাঁর জন্যে পালাম বিমানবন্দরে শুভেচ্ছা বার্তাসহ পুষ্পমাল্য পাঠিয়েছিলেন।
নয়াদিল্লী ক্যান্টনমেন্টের প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল মহাসমাবেশে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান আমাদের মহান নেতা। বঙ্গবন্ধু বলেন-‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সেনাবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এমন কোনো জায়গা নাই, যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে এবং তাঁর সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি লোকের খাওয়ার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন, আমি জানি, ভারতবর্ষে অনেক মানুষ দুঃখে আছেন যারা কষ্ট পেয়েছে, তাদেরও অসুবিধা আছে, তা সত্ত্বেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে আমার লোককে সাহায্য করার জন্য। চিরদিন মনে রাখবো আমরা, তা ভুলতে পারবো না।’ গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের সম্পর্ক আর আদর্শিক ঐক্যের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘আমি বিশ^াস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ^াস করি সোশ্যালিজমের মন্ত্রে। আমাকে প্রশ্ন করা হয় যে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আদর্শের সঙ্গে আপনার এত মিল কেন ? আমি বলি, এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা বিশ^শান্তির মিল’।
বঙ্গবন্ধু বলেন,‘পাকিস্তানীরা যখন আমাকে আমার জনগণের মধ্য থেকে (বন্দী করে) নিয়ে যায়, অনেক কেঁদেছিল তারা। আমার বন্দীত্বের সময় সেই কেঁদে-ওঠা মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো জীবনযুদ্ধে। আর আমি যখন দেশে ফিরে যাচ্ছি তখন তারা বিজয়ী। লক্ষ লক্ষ বিজয়ী মুখের হাসির মাঝে আমি ফিরে যাচ্ছি। এক জীবনপণব্যাপী বন্দীত্ব থেকে আমি ফিরে যাচ্ছি মুক্ত, স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশে। সামনে যে ব্যাপক কাজ পড়ে রয়েছে সেখানে আমার জনগণের সঙ্গে তা (সম্পন্ন) করবার সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমাদের দেশে-বাংলাদেশে। সামনে যে পথ আমরা রচনা করব তা হবে শান্তির এবং প্রগতির পথ, কারো জন্যে কোন ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না। মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়, অশুচিতার ওপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সার্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটেই আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে-রক্তস্নাত ও শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে।’ ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং একই সাথে বন্ধুত্বের এই বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর বীরোচিত পদার্পণ এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি করে। ১০ জানুয়ারি যেন স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল বাঙালির আর এক মহাজাগরণের দিন, এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নিজ বাসভূমে ফিরে এলেন। স্বাধীন স্বদেশে আমাদের মুক্তির মহানায়কের মহাপ্রত্যাবর্তন- এ আমাদের জন্য অনেক বড় আনন্দের, অনেক বেশি গর্বের। আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি ও তৃপ্তি। বঙ্গবন্ধুর শুভাগমন তথা ম্ক্তু-স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে ঢাকার মানুষ আনন্দ-উল্লাস-উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। আনন্দ আর আবেগে সবাই উদ্বেলিত। সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। লন্ডন থেকে নয়াদিল্লী হয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর নিজের দেশ, নিজের মাটিতে ফিরে আসছেন-মহান নেতাকে প্রাণের অর্ঘ্য ও ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নিতে ভোর থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে বাংলার মানুষ। ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লী থেকে ঢাকা সর্বত্রই ছিল আনন্দের বন্যা- প্রাণের জোয়ার। দলে দলে মানুষ বঙ্গবন্ধুর নামে ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার আর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দুপুরের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের সমাগমে সারা রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। সেখানেই বাংলার জনগণের প্রাণের সারথিকে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বস্তরের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে। রেসকোর্স ময়দান থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর পর্যন্ত সব রাস্তাঘাট অলিগলি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সেদিন বাংলাদেশের সব পথ যেন একসাথে মিশে গিয়ে এক পথ একাকার হয়ে পড়েছিল। সেদিন বাংলার মানুষ আবালবৃদ্ধবণিতা আনন্দ-উল্লাস-চঞ্চলতায় আত্মহারা হয়েছিল। সব বাধা নিষেধ অমান্য করে মুক্তির মহানায়ককে কাছে থেকে দেখার জন্য বিমানবন্দরের ভেতরে ও অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
রাজপথে, হাটে, মাঠে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল তাঁকে এক নজর দেখতে। ইতিমধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে আসার পথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হতে পারে। একে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন ছিল, কারণ তখনও রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স ও পাকিস্তানের বহু এজেন্ট মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে খোলস পাল্টে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নিরাপদ বিভাগের পরামর্শ ছিল বঙ্গবন্ধুকে আর্মার্ড কারে অথবা সম্ভব হলে ট্যাংকে করে এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনাস্থলে নিয়ে আসার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দ্রুত একসাথে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে- এই দায়িত্ব নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে তাদেরই বেশি। অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার সমস্ত দায়িত্ব নিল ছাত্রলীগ। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত পুরো রুটেই তাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন বিভিন্নভাবে সবগুলো রাস্তায় জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তাঁরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন স্বদেশ থেকে মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন। লন্ডন থেকে নয়াদিল্লী হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ কমেট জেট বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে বেলা ১টায় একত্রিশ বার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিল তাঁর প্রিয় স্বদেশভূমি। মানুষে মানুষে রাজপথের অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, লক্ষ লক্ষ বাঙালির উষ্ণ ভালোবাসা, স্নেহের পরশ আর ফুলেল শুভেচ্ছা দেয়াল ভেদ করে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘন্টা। বেলা ১টায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী কমেট বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করতেই হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার রাইফেলের ফাঁকা শব্দে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। উপস্থিত জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ও করতালি দিয়ে সমগ্র বিমানবন্দর কাঁপিয়ে তুলে ছিল।বিমানটি বাংলার মাটি স্পর্শ করার পর হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য ছুটাছুটি শুরু করে। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো বিমানের চারদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বিমানের ওপর তখন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে। লাখো জনতার দৃষ্টি তখন বিমানের দরজায় নিবদ্ধ। উপস্থিত জনস্রোত সেই মুহূর্তে কোনো অফিসিয়াল বাধা মানেনি। বিমানের দরজা খুলতেই বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে বিজয়-অভিবাদন জানালেন। চারদিকে উল্লসিত-উদ্বেলিত জনতার গগনবিদারী স্লোগান।
স্মিতহাস্যে বঙ্গবন্ধু দুই হাত নেড়ে একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙে বিমান থেকে নেমে আসছিলেন। সেটি ছিল এক বিরল মুহূর্ত- ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ বাঙালির জীবনে। তোপধ্বনি হলো, বিউগলে বেজে উঠলো জাতীয় সংগীতের সুরের মূর্ছনা। সেই সুরে সুর মেলালো বাংলার লাখো মানুষ। ভিড়ের চাপে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে আনা যায়নি। আনুষ্ঠানিক পুষ্পমাল্য দান ও সালাম জানানোর পূর্বেই সহস্র ফুলের মালা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানালো বাংলার জনগণ। একটি হুইল চেয়ারে বসে বিমানবন্দরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান। নত শিরে হাত নেড়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতাকে সালাম জানান। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে গেলে এক করুণ হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণ হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লেন বঙ্গবন্ধু। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হায়রে স্বাধীনতা, তোর জন্যে আমার ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে বলি দিতে হলো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধু আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কিছুই বলতে পারলেন না; শুধু উচ্চারণ করলেন, ‘আমার তাজ’ সবাইকে জড়িয়ে ধরে বঙ্গবন্ধু চুমু খাচ্ছিলেন। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে নজরে পড়তেই বঙ্গবন্ধু ছুটে গেলেন তাঁর কাছে এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আপনি আমার গর্ব। আপনি আমার জাতির সম্মান রক্ষা করেছেন। কিন্তু হায় আমার বাঙালির বুকে আজ শোক আর চোখে অশ্রুজল। এরপর বঙ্গবন্ধু একে একে উপস্থিত অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, যুব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হলেন। অবশেষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীসহ নেতৃবৃন্দের মাঝে ফুলে ফুলে ভরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ট্রাকমিছিল এগিয়ে চলে রেসকোর্সের দিকে। বাংলার মানুষ সেদিন আনন্দ-উল্লাস-আবেগ-ভালোবাসা দিয়ে সকল বাধা ডিঙিয়ে প্রাণের উচ্ছ্বাসে একই মিলনমোহনায় মিলিত হয়েছিলো, কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সবার মনোযোগ ও দৃষ্টি তাঁর দিকে। মিছিলে মিছিলে ব্যান্ডের তালে তালে বাজি পুড়িয়ে উৎসবে মেতে ওঠেছিল সকল মানুষ। উৎসব করতে গিয়ে সেদিন কয়েকজন মানুষ মৃত্যুবরণও করেছিল।
রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সংবর্ধনা মঞ্চে মাইকে বক্তারা যখন মাইকে তাঁর প্রিয় বাংলার আকাশে বঙ্গবন্ধুর প্রবেশের খবর ঘোষণা করল, তখন সাথে সাথে যেন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলি-সুরমার ঢেউয়ের স্রোতোধারার উর্মীলিত ঢেউয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছিল মানুষের গগনবিদারী স্লোগানের আওয়াজ। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠান শুরুর একরকম আগেই হাজারো ফুলের মালায় ঢেকে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সারা শরীর। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার দুই চোখ বেয়ে বারবার গড়িয়ে পড়ছিলো অশ্রু। আসলে রেসকোর্সে তাঁর অন্তর আবেগে আপ্লুত হয় এবং তাঁর চোখ ছিলো আনন্দাশ্রুতে প্লাবিত। নিজেকে সামলে নিজে বঙ্গবন্ধু তাঁর আবেগঘন বক্তৃতা আরম্ভ করেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর আবেগস্পন্দিত কন্ঠের ভাষণ শুনে সারা রেসকোর্স ময়দান এবং রেডিওর সামনে বসা লক্ষ লক্ষ মানুষ স্তম্ভিত নিঃস্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন যে, বক্তৃতার মাঝে মাঝেই তাঁর দু’চোখ অশ্রুজলে ঝাপসা হয়ে গেছে বারবার। তাই তাঁকে বারবার চশমার লেন্স মুছতে হয়েছে। তার মধ্যেও তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে তার সিংহভাগ জুড়েই ছিল দেশ ও দেশের মানুষের কথা- ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে সম্মিলিত উদ্যোগে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। তাঁর বক্তৃতায়। বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তিনি বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ^বাসীর কাছে সহযোগিতা চান। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় কীভাবে রূপান্তর করা যায় তার পরিকল্পনায় কথাও জানান। দৃপ্তকন্ঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন দেশ পুর্নগঠন কাজ পরিচালিত হবে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ভাষণের শুরুতেই আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ তাঁর সারা জীবনের সাধনা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বাংলার মানুষের মুক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশে এসে বাংলার মানুষকে কাছে পাওয়ায় তিনি আজ আনন্দে উদ্বেলিত, আবেগে আপ্লুত।
বাংলায় আপামর জনগণের প্রতি তিনি সালাম জানান। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন: ‘ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।’ ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার, ভারতের জনগণ, ব্রিটেন, জার্মানী, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীত্ব অবস্থার কথা স্মরণ করেন। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে তাঁকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র এবং তাঁর ওপর নানা ধরনের মানসিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেন। শাসকগোষ্ঠীর শত নিপীড়নের মধ্যেও আমাদের অবিসংবাদিত নেতা মাথা নত করেননি। বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো আপস করেননি। একজন বাঙালি, একজন মানুষ, একজন মুসলমান, একজন বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে নিজের পরিচয়কে অর্জনে দৃঢ়প্রত্যয় ও দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার মূল কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলার মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ^াস রেখে আত্মপরিচয়ে বলীয়ান বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মুসলমান একবারই মরতে জানে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব- আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তাদের আরো বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনরায় গড়ে তোলার দায়িত্ব তিনি বাংলার মানুষের ওপর অর্পণ করেন। সবাইকে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে যার যার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবার আন্তরিক আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার কথা গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই বাংলাদেশে সমান মর্যাদা নিয়ে শুখে শান্তিতে বাস করবে এবং এদেশের কৃষক-শ্রমিক সর্বস্তরের আপানর জনগণের সমান অধিকার নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন।
পাকহানাদার বাহিনী যেভাবে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে, অন্যায়-অত্যাচার চালিয়েছে তার কথা বেদনা ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করেন। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণের অপরিসীম কষ্ট ও ত্যাগকে। যে-কোন মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বের কথা বঙ্গবন্ধু পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন বাংলাদেশের মানুষকে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল আত্মদানকারী শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিবাহিনী, গেরিলাবাহিনী, কর্মীবাহিনী, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সকল শ্রেণিপেশার সর্বস্তরের জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা ও সালাম জানান। বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর ভাষণটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ভাষণকে স্মরণ করি। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এঁর পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে।
রেসকোর্সের লাখো জনতার মাঝ থেকে এবার বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গের মাঝে ফিরে আসার পালা। শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারবর্গকে একান্ত আপন পরিবেশে কাছে পেলেন। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে পুত্রবধূর বাসবভনে বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং অশীতিপর বৃদ্ধা মাতা বেগম সায়েরা খাতুনও পৌঁছেন। এই গৃহেই বিগত নয় মাস বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব, জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, ছোট ছেলে রাসেল ও নাতি জয়সহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের নয়জন সদস্য দখলদার বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন। ওই দিন সকাল থেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেগম মুজিব ছিলেন অনন্য এক ঘরোয়া পরিবেশে। বাড়ির সব ছোটমণিদের হাতে ছিল লাল লাল ফুল। ছোট্ট রাসেল সোনাই ছিল এই ফুলকলিদের মেলার মধ্যমণি। ‘আব্বু আসবে’ -তাই রাসেলের আনন্দ ধরে না। বেতারের ধারাবিবরণীতে বিমানের নিরাপদ অবতরণের খবর প্রকাশের পর বেগম মুজিব স্বস্তির নিঃশ^াস ফেললেন। বেতার ধারাবিবরণীর প্রতিটি শব্দ যেন তাঁরা সবাই হৃদয় দিয়ে মনেপ্রাণে শুনছেন। বাসায় টেলিভিশন ছিল না। তাই বেতার ধারাবিবরণীই ছিল তাঁর মুহূর্তগুলো ধরে রাখার একমাত্র অবলম্বন। বিকাল ৪:৩৪ টায় বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সের জনসমুদ্রে অবগাহন করেন, তখন বাড়িতে বেগম মুজিবের রুদ্ধশ^াস অবস্থা। বেতারে এক সময় যখন বলা হয় ‘নেতা কাঁদছেন’- হঠাৎ সকল বাঁধ ভেঙে যায়। অঝোর ধারায় কান্নার বন্যা নেমে আসে বেগম মুজিবের দুই নয়নে। কাঁদছেন বঙ্গমাতা; কাঁদছেন তাঁর ছেলেমেয়ে ও আপনজনেরা। কাঁদছে বাংলার কোটি কোটি মানুষ। সন্ধ্যা পৌণে ছয়টায় স্বাধীন বাংলার পতাকাবাহী একটি সাদা ক্যাডিলাক গাড়ি প্রবেশ করল এই বাড়ির প্রবেশদ্বারে গাড়ির দরজা খুলে গেল। নেমে এলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও হাজী গোলাম মুর্শেদ প্রিয় নেতা বারান্দা, বৈঠকঘর অতিক্রম করে অপেক্ষমাণ স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হলেন। তারপরই ভেসে আসে মিলিত কান্নার ধ্বনি। বাড়ির সবখানে সবার মধ্যে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, আবেগ। কতদিন পর সবার সাথে দেখা! কারো সাথে কারো দেখা না-ও হতে পারতো।
এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুদীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর পরিবার-পরিজনদের সাথে মিলিত হলেন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ১০ই জানুয়ারি এক অবিস্মরণীয় স্মৃতিভাস্বর দিন। প্রতিবছর এই দিন আমরা নতুন চেতনায় জেগে উঠি- স্নাত ও উদ্ভাসিত হই বঙ্গবন্ধুর চেতনাদর্শে। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, মুক্তি পেয়েছেন, বাড়ি ফিরেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটক এবং সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত তাঁর বন্দীজীবনের প্রায় পুরো সময়টা কেটেছে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ও তিনি বাংলাদেশেই আটক ছিলেন। জেলের ভেতরে ও বাইরে ছিল বালাদেশের মানুষ। তিনি দেশের মাটিতে দেশের আলো-বাতাসের মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু একাত্তরের নয় মাসের ওপর তিনি যে বন্দী ছিলেন শক্রদেশ পাকিস্তানের লায়ালপুর, মিয়ানওয়ালি প্রভৃতি স্থানে কারাগারের নির্জল সেল-এ। তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে, বৈরী মানুষ, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার দীর্ঘ নয় মাস নির্জন বন্দীত্ব অবস্থা শেষ করে লন্ডন, নয়াদিল্লী হয়ে ঢাকায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং তারপর বাংলার মানুষ ও পরিবার পরিজনের সঙ্গে মিলিত হওয়া এসব কিছু তাঁর আগের যে-কোন সময়ের বন্দীত্ব অবস্থা থেকে আলাদা। বৈরী পরিবেশে, প্রতিকূল আবহাওয়ার শক্র পরিবেষ্টিত হয়ে নির্জন ‘সেল’-এর আটক ছিলেন বহির্বিশ^ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে। অবশেষে স্বদেশে ফিরে এলেন বিজয়ী বীরের বেশে। বঙ্গবন্ধু এই মহান ত্যাগ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির জন্য। সশ্রদ্ধ অভিবাদন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।