“মুক্তিযুদ্ধে অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম- (০৬)”
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যমূলক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মূলতঃ পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যায়নরত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতির মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তারপর জাতীয় চেতনার অগ্রদুত, এ কালজয়ী কিংবদন্তীর মহানায়কের নেতৃত্বে, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বহু রক্তাক্ত আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি ধাপে-ধাপে শৃঙ্খল মুক্তির চুড়ান্ত গন্তব্যের পথে অগ্রসর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের ০৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামীলীগের এক আলোচনা সভায় বাংলা মায়ের এ সর্বশ্রেষ্ঠ অগ্নিসন্তান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন বাংলাদেশ।
অতঃপর ১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার সাধারণ মানুষের ভোটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া স্বার্থে ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ধরণের তালবাহান শুরু করে। এক পর্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এতে সমগ্র বাংলার মুক্তিপাগল মানুষ আপন ইচ্ছায় সাড়া দেয়। ১৯৬৯ এর ০৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানীদের দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন-শোষন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুনির্দিষ্টভাবে রূপ রেখা প্রদান করেন। মূলতঃ ০৭ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই পরিচালনা করেন এবং বাংলার মুক্তিপাগল ক্ষুব্ধ জনতা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ থেকে ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২৩ মার্চ সমগ্র দেশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত্র পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাথে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী-ভুট্টো’র বৈঠক অব্যাহত থাকে, যা ২৫ মার্চ ব্যর্থ হয়ে যায়। ঐদিন সন্ধ্যায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকা ত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। তারপর গভীর রাতে দখলদার হিংস্র বর্বর পাক-বাহিনী ঢাকাসহ দেশের অসংখ্য স্থানে নিরস্ত্র ঘুমন্ত অসহায় মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে ভয়ানক কালোরাতে বর্বর পাকবাহিনী ট্যাংক চালিয়ে ও মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষন ও লুটরাজের মাধ্যমে মানব সভ্যতার ইতিহাসকে নজিরবিহীনভাবে কলংকিত করে।
অতঃপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে রাত ১২.২০ ঘটিকার সময় বাঙালী জাতির অবিসাংবাদিত নেতা মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। পাক-বাহিনী রাত ১.৩০ ঘটিকার সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। অপরদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষনাটি তাৎক্ষনিকভাবে ইপিআর এর ওয়্যারলেস থেকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। আর চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন কিছু সংখ্যক মীর জাফর আর অমানুষ ছাড়া বলতে গেলে সকল দেশ প্রেমিক জনগণ কোন না কোনভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। সে সময় সারা দেশের মতো অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামে ও বেজে উঠেছিল স্বাধীনতার দামামা। পাহাড়ের মুক্তিপাগল বীর সেনাদেরও রয়েছে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অনন্য বীরত্বগাঁথা। নতুন প্রজন্মের কয়জনই বা জানে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মধ্য ও যে, একজন খেতাবধারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র “বীর বিক্রম” খেতাবপ্রাপ্ত পাহাড়ের বীর সন্তানের নাম ইউ কে চিং (উক্যচিং)। তিনি আমাদের পার্বত্য বান্দরবানের মারমা জনগোষ্ঠির এক অকুতোভয় অগ্নিসন্তান পাহাড়ের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। চির সবুজ বান্দরবানের শঙ্খ নদীর পড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে লংগীপাড়ার এক কুঁড়ে ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে যার ছিল স্থায়ী নিবাস।
একটি ভাঙ্গা কুড়ে ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে, অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে শত কষ্টের মাঝে যিনি সেখানে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। অবশেষে স্বাধীনতার বহু বছর পর পাহাড়ের এ অগ্নিপুরুষ ইউ কে চিং বীর বিক্রমের দুঃখ-বেদনার কথা বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ খরব বান্দরবান সেনা রিজিয়ন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি গোছর হলে, অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে তাঁরা পাহাড়ের এ বীরপুরুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। বান্দরবান ৬৯ পদাতিক বিগ্রেড পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র বীর বিক্রম খেতাব প্রাপ্ত এ অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং এর বাড়ীটি পুনঃনির্মাণ করে দেয়। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর বাড়ীর পাশে একটি দোকান ঘরে ছোট-খাটো ব্যবসা করার জন্য ব্যবস্থাও করে দেন সেনা কর্তৃপক্ষ। বাল্যকাল থেকেই পাহাড়ের এ কৃতি সন্তান অসীম সাহসী ছিলেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে সার্বিক দিক বিবেচনায় তিনিই ছিলেন অন্যতম। ১৯৫২ সালে দেশপ্রেমিক এ অগ্নিতরুন ইউ কে চিং বীর বিক্রম ইপিআর-এ যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথা ইতিহাসের অন্যতম অংশীদার আমাদের অগ্নিসন্তান ইউ কে চিং বীর বিক্রম। মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ খেতাবধারী সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র বীর বিক্রম তিনি।
১৯৭১ সালে তিনি রংপুর ইপিআর উইংয়ের অধীন লাল মনির হাটের হাতীবান্ধা বিওপিতে ইপিআর এর নায়েক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে তিনি একাই একজন বিহারী এবং দুইজন পাঞ্জবীর সাথে যুদ্ধ করে এবং তাদের হত্যা করার পর ০৯ জন বাঙালী ইপিআর সৈনিককে সাথে নিয়ে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতঃপর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়ার পর তিনি পাটগ্রাম এলাকায় অবস্থান নেন। পরে ০৬ নম্বর সেক্টরের অধীন সাহেব গঞ্জ সাব সেক্টরে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সংলগ্ন চৌধুরী হাটে এক ভয়ানক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, গিরিদুলালীর এ উজ্জ্বল নক্ষত্র ইউ কে চিং বীর বিক্রম। সে রক্তঝরা এক ভয়ানক যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট আবু মঈন আশফাকুস সামাদ বীর উত্তমসহ আরো বেশ কয়েকজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরন করেন। এ মহান বীর শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। পরম করুনাময় আল্লাহ তাঁদের জান্নাত দান করুন-এ দোয়াই করি। আর তাঁদের অম্লান স্মৃতির প্রতি জানাই- বিনম্র শ্রদ্ধা।
ভাগ্যক্রমে এ ভয়ানক রক্তাক্ত সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণে বেঁচে যান- পার্বত্য চট্টগ্রামের এ অগ্নিতরুন বীর সেনানী ইউ কে চিং বীর বিক্রম। ১৯৭১ সালের সেই অগ্নীঝরা দিনে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডারের অধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা একবার মাঠ পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি আমাদের এ অদম্য বীর সেনানীর প্রতিরক্ষার কলা-কৌশল শুনে আনন্দ বন্যায় ভেসেছিলেন। অতঃপর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পাহাড়ের এ অদম্য বীর সন্তানকে, বেশ কিছু সময় বুকে জড়িয়ে ধরে, তাঁর সাথে চলে যেতে বললেন। প্রতি উত্তরে আমাদের এ বীর পুরুষ সেদিন বলেছিলেন, স্যার ক্ষমা করবেন। এ দেশ আমার মা, বাংলা মায়ের বুক ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। আমি সৈনিক এ দেশে জন্মেছি, দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে হাসি মুখে এ দেশে-ই মরবো। আমি দেশের বুকে যুদ্ধের মাঠেই থাকবো। পাহাড়ের এই সূর্য্য সন্তান শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মাঠেই ছিলেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে মরনপণ করে যুদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলার স্বাধীনতার জন্য তিনি অসামান্য অবদান রাখেন, তাঁর এ অবদান চির ভাস্কর হয়ে থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকার তারই স্বীকৃতি হিসাবে তাঁকে বীর বিক্রম উপাধীতে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত দি বাংলাদেশ গেজেট এক্সট্রা অর্ডিনারি পাবলিশড বাই অথরিটি বইয়ের ক্রমিক নম্বর ১০০-তে তাঁর “বীর বিক্রম” খেতাব প্রাপ্তীর উল্লেখ রয়েছে। ২০১০ সালে ইউ কে চিং বীর বিক্রমের নামে বান্দরবানের একটি সড়কের নামকরণ করা হয। তারপর নীলাচলে এ বীর পুরুষের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়।
২০১৪ সালের ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ অকুতোভয় বীর সেনানী জীবন যুদ্ধে হেরে যান, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পাহাড়ের এ চিরঞ্জীব সূর্য্য সন্তান বীর বিক্রমের প্রতি-অজশ্র বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী। তিনি যেন নির্বান লাভ করেন-এ প্রার্থনাই করি। এ মহান মানুষটির ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া বলতে কিছুই ছিলনা। মৃত্যুর আগে কোন আড্ডার আসরে কিংবা সাক্ষাৎকারে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কথা উঠলে তিনি প্রায় সময় বলতেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সবুজের বুকে লাল একটি পতাকা পেয়েছি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর আমার কাছে অবশিষ্ট কিছুই নেই। এ দেশে এখনো অসংখ্য মহৎ মহান বিশাল মনের ত্যাগী মানুষ রয়েছে, যারা দেশের এবং মানুষের কল্যাণে কল্যাণমিত্র হয়ে নিজেকে উজার করে বিলিয়ে দিয়েছে, মরনপণ করে যুদ্ধ করেছে। তাঁরা না-চাইলেও কি যেচে গিয়ে, সহযোগীতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন নয় কি ? পাহাড়ের অহংকার দেশের এ শ্রেষ্ঠ সন্তান অদম্য বীরসেনা ইউ কে চিং (উক্যচিং) বীর বিক্রম আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি স্ত্রীসহ দুই সন্তান, এক কন্যা, তিন নাতি ও ছয় নাতনী রেখে যান। এ বীর বিক্রম ইউ কে চিং এর মৃত্যুর পর থেকে পরিবার পরিজনরা এখন প্রতিনিয়ত অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধ করে চলছে। জানিনা এ কঠিন যুদ্ধের শেষ হবে কবে ?
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, শতাব্দীর মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বীর শহীদ ও অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সম্ভ্রম হারা মা-বোনদের প্রতি জানাই-বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।