[vc_row][vc_column css=”.vc_custom_1596871563159{margin-bottom: 0px !important;}”][vc_column_text css=”.vc_custom_1596874329023{padding-top: -30px !important;}”]

শিরোনাম
দীঘিনালায় যৌথবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ কর্মী আটকবান্দরবানে রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবন জোড়পূর্বক দখলের অভিযোগবান্দরবানের থানচিতে ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশমানিকছড়িতে চাঁদাবাজি করতে এসে জনতার হাতে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকবরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগরাঙ্গামাটির লংগদুতে নৌকার কিছু নেতাকর্মী এখন ট্রাকে উঠে গেছেকাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টাসড়ক দুর্ঘটনায় কাপ্তাই বিএফআইডিসি এলপিসি শাখার কর্মচারী নিহতমানিকছড়ির নবাগত ইউএনও’র সাথে বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা বিনিময়খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
[/vc_column_text][/vc_column][/vc_row]

মুক্তিযুদ্ধে অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম-(০১)

১২৮

॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বিজয়। বাঙালী জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিষ্মরনীয় গৌরব দীপ্ত চুড়ান্ত বিজয় আসে-১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষার ভিত্তিতে আমাদের যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত মহান স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছে ৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে। বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ, স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। হাজার বছরের বঞ্চিত জাতি অর্জন করে, নিজস্ব ভূখন্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা-বিজয় নিশান। ১৯৭১ সালের ০৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই ভাষনে উদ্দীপ্ত সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষগুলো ও সেদিন স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় শপথ নেয়। অবিভক্ত বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু সংখ্যক চিহ্নিত বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফর ছাড়া বলতে গেলে সর্বস্থরের মানুষ-ই স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন না-কোন ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে দেশ স্বাধীন না-হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন-মরণ বাজী রেখে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তখন সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের অবস্থান তেমন একটা শক্তিশালী ছিল না। তৎকালীন সময় অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন হোসেন তৌফিক ইমাম যাকে আমরা সচরাচর এইচ.টি ইমাম (বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রি পরিষদ সচিব) নামে চিনি এবং জানি। গেরিলা কৌশলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ০১নং সেক্টরের আওতাধীন। তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিভক্ত জেলা সদর আজকের রাঙ্গামাটি সদর। আর রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবান এ তিন মহকুমা নিয়ে-ই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠিত ছিল। অবিভক্ত জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর রাঙ্গামাটি, জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারার সাথে মিলে-মিশে একাট্টা হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই জেলা প্রশাসক এইচ.টি ইমাম স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অবিভক্ত জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গমাটি সদরে গড়ে উঠে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৭১ সালের শুরুতেই প্রথমে ইন্দ্র নন্দন দত্ত-কে আহ্বায়ক ও সুনীল কান্তি দে’কে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর কমিটি গঠিত হয়। তবে কিছুদিন পর রাঙ্গমাটি সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান ও সুনীল কান্তি দে’র নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কার্য্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ রামগড় মহকুমার কাজী রুহুল আমিন-কে আহ্বায়ক এবং সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরাকে যুগ্ন আহ্বায়ক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। খাগড়াছড়িতেও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এর আহ্বায়ক এর দায়িত্ব পান দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রেখে দেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন, রাজপথে মিছিল-শ্লোগান, আন্দোলন, প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই সংগ্রাম পরিষদের উদ্দেশ্যেও লক্ষ্য ছিল। শুরু থেকেই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসক এইচ.টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমানের সাথে সমন্বয় পূর্বক স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী এখানকার মুক্তিকামী, স্বাধীনতা প্রেমী ও সংগ্রামী বীর জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রাঙ্গমাটির পুলিশ লাইন ও ষ্টেশন ক্লাবের মাঠে স্বাধীনতা যুদ্ধের অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। সেখানে অস্ত্র চালানো সহ ছাত্রদের ককটেল তৈরীর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ককটেল বানানোর কাজে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের বিজ্ঞানাগারের রসায়ন বিভাগের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হতো। এরিমধ্যে জেলা প্রশাসক এইচ.টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান সহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ভারত চলে যান। এমতাবস্থায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী এখানকার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি দখল করার পর বান্দরবান ও দখল করে নেয়। এরপর ১৬ এপ্রিল এ দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং বন্দী অবস্থায় অমানবিক নির্যাতনে তিনি শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল এ মহান বীরের ক্ষত-বিক্ষত দেহ টুকরো টুকরো করে কেঁটে বস্তায় ভরে কাপ্তাই হ্রদে ফেলে দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর এ বীর সেনানীর স্মৃতি রক্ষায় রাঙ্গামাটির সর্বস্থরের মানুষ এবং স্থানীয় প্রশাসন জেলা সদরের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েদে আজম মেমোরিয়াল একাডেমীর নাম পরিবর্তন পূর্বক শহীদ আবদুল আলী একাডেমী নামকরণ করেন। ১৯৭২ সালের ০৮ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে শহীদ আবদুল আলী’র এ অবদানের স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর এ মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুল আলীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য ২০১৬ সালে মরনোত্তর স্বাধীনতা পুরষ্কারে ভূষিত করে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি পৌর এলাকার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় সংলগ্ন স্থানে শহীদ আবদুল আলী’র স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে। সারা দেশের মতো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও অত্যান্ত হৃদয় বিদারক এবং গৌরবের। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ১৯৭১-এর ২৯ মার্চ রাঙ্গামাটির ছাত্র যুবকদের একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান। স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণ শেষ করে তাঁরা। অতঃপর রামগড় সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা মহালছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

বীর যোদ্ধাদের এ দলটি যখন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি এসে পৌঁছাল, ঠিক তখনই এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সুত্রপাত ঘটে। রাঙ্গামাটির কিছু অমানুষের বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে সেখানে আগে থেকেই পাক সেনারা উৎপেতে ছিল। রাঙ্গামাটির কৃতি সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুল শুক্কুর, এস.এম কামাল, শফিকুল ইসলাম, ইফতেকার, ইলিয়াস, আবদুল বারী, মোঃ মামুন ও আবুল কালাম আজাদ পাক-বাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ নৌকার মাঝির (নৌকা চালক) অভিনয় করে প্রাণে বেঁচে যান। ভাগ্যক্রমে ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী’র ও জীবন রক্ষা হয়। কিন্তু ধৃত অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করা হয়। শহীদ আবদুল শুক্কুরের মুক্তিযোদ্ধার দলটির পিছনে আরো দুটি দল ছিল। দলগুলো পাক-বাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। পরে দু’দলের একটি দল কাপ্তাই হ্রদে অবস্থান করে এবং অপরটি আলম ডক ইয়ার্ডে উঠে। অতঃপর মুক্তিবাহিনীর দল সমূহ রাঙ্গামাটি শহর ত্যাগ করে এবং সদরের কতুকছড়িস্থ বাকছড়িতে অবস্থান গ্রহণ করে। পরের দিন বাকছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা টহলরত পাক-বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, টিলা, খাল-বিল, নদী-নালা হ্রদ এবং প্রতিটি জনপদে মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধের অজশ্র অনন্য গৌরব গাঁথা। যা আমাদের জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সাহস যোগায়। পাক-বাহিনী রাঙ্গামাটি শহর দখল করার পর, বুড়িঘাট নানিয়ারচর হয়ে মহালছড়ির মুক্তিবাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা কেন্দ্রে আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন। পূর্বের সিদ্ধান্ত মতে ২০ এপ্রিল নদী পথে তারা যাত্রা শুরু করে। ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ রাঙ্গামাটি মহালছড়ির জলপথে কোম্পানীর মেশিনগানার হিসাবে পাহারা দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

সেদিন পাক-বাহিনীর বড় একটি দল ০৬ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে ০৩টি লঞ্চ ও ০২টি স্প্রিডবোট বোঝায় করে প্রতিরক্ষা (বুড়িঘাট) এলাকায় ঢুকে পড়ে। মুক্তিবাহিনীদের দেখা মাত্র পাক সেনারা ০৬ ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে গোলা বর্ষন শুরু করে। প্রচন্ড তোপের মুখে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এমনই এক ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল যে, পিছিয়ে যাওয়া ও তখন নিরাপদ ছিল না। তখন বিষম ভাবনায় পড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এ মুহুর্তে কভারিং ফায়ার ছাড়া বিকল্প নেই। তিনি কাউকে কিছুই বলছেন না। কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন, কভারিং ফায়ার দিতে হলে মৃত্যুকে বরণ করেই দিতে হয়। এমনই এক ভয়ানক কঠিন সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ মেশিনগান হাতে এগিয়ে আসলেন। নিজে যেচে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের উদ্দেশ্যে বললেন- স্যার, আমি মেশিনগান ভালো চালাতে পারি, আপনি সবাইকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। আমি কভারিং ফায়ার দিচ্ছি….। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তাঁর বাহিনীর প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদে মহালছড়ির দিকে পিছিয়ে গেলেন। একমাত্র বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ পিছু হটলেন না। একটি বট গাছের আড়াল থেকে মেশিনগান দিয়ে পাক-বাহিনীর উপর গোলা বর্ষন অব্যাহত রাখলেন। তাঁর অবিরাম গোলা বর্ষনে পাক-বাহিনীর ০২টি লঞ্চ ও ০১টি স্প্রিড বোট হ্রদের জলে ডুবে যায়। এতে ০২ প্লাটুন শত্রুবাহিনী সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়। অক্ষত নৌযান গুলোর কিছু সংখ্যক শত্রুসেনা গোলা বর্ষন করতে করতে পিছু হটতে থাকে। এ সময় হঠাৎ শত্রু বাহিনীর মর্টারের গোলা তাঁর অবস্থানে এসে পড়লে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। এই মহান বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আবদুর রউফ এর অসীম বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণে বেঁচে যান এবং পাক-বাহিনী সেদিন আর মহালছড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের মূল প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি।

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এ মহান বীর সেনানীর নিরব-নিথর প্রাণহীন দেহটি বুড়িঘাটের বাসিন্দা দয়াল চাকমা পরম শ্রদ্ধাভরে কবর দেন। অতঃপর এ অকুতোভয় বীর সৈনিকের সমাধিটি খুঁজে পেতে আমাদের সুদীর্ঘ ২৫টি বছরও পেরিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি শহর থেকে ২৫ কিঃমিঃ উত্তরে বাংলা মায়ের এ শ্রেষ্ঠ বীরের সমাধিতেই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজের শুভ সুচনা হয়। তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস এর রাঙ্গামাটি সেক্টর হেড কোয়াটারের উদ্যোগে, এ বীর সেনানীর বুড়িঘাট ইউনিয়নের কমতলী পাড়া এলাকাস্থ সমাধিতেই এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ৮ম ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এর কিছু বাঙালী সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁরা এক পর্যায়ে পাক-বাহিনীর উপর আক্রমন এবং পশ্চাদপসরণ কৌশল অবলম্বর পূর্বক আস্তে আস্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে উপস্থিত হন। বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ রাঙ্গামাটি-মহালছড়ির কাপ্তাই হ্রদে জলপথে কোম্পানীর মেশিনগানার হিসাবে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৩ সালে ০৮ মে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার (বর্তমানে মধুখালী) সালামতপুর (বর্তমানে রউফ নগর) গ্রামে এ মহান বীরের জন্ম। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হোসেন এবং মাতার নাম মুকিদুন্নেসা। এ অকুতোভয় বীর সেনানী, দেশ প্রেমিক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এ যোগ দেন। তাঁর অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশ প্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান সূচক “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতা অর্জনে এ মহান বীরশ্রেষ্ঠসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ চির স্মরনীয় হয়ে থাকবে। আমরা-এ বাংলার রাখাল রাজা, সর্বশ্রেষ্ঠ মহা মানব, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বীর সেনানীর প্রতি জানাই-বিনম্র শ্রদ্ধা…………….

লেখকঃ- মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী