সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে দাম পাচ্ছেন না পাহাড়ের চাষিরা
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় রাঙ্গামাটিতে জাম্বুরার বাম্পার ফলন
॥ শাহ আলম ॥
পার্বত্য অঞ্চল রাঙ্গামাটি জেলার পাহাড়ে কৃষকদের উৎপাদিত সুস্বাদু ফলের অন্যতম নাম বাতাবি লেবু বা জাম্বুরা। জাম্বুরার চারা রোপণের ৫-৭ বছরের মধ্যে ফলন পাওয়া সম্ভব। গাছের গড় আয়ু ৩০-৫০ বছর, ধারাবাহিকভাবে ফলনও পাওয়া যায় এ সময়।
পুষ্টিবিদদের মতে ‘জাম্বুরা ঠান্ডা, সর্দি-জ্বর, ডায়াবেটিস, মুখের ঘা ও পাকস্থলীসহ বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী। এ ফল রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর এবং পেটের নানা রকম হজমজনিত সমস্যার জন্যও উপকারী। জাম্বুরা ক্যান্সার প্রতিরোধেও বেশ কার্যকর। পাহাড়ে উৎপাদিত জাম্বুরা মানসম্মত ও সুস্বাদু। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে এই জাম্বুরার কদর। ভিটামিন-সি সম্বৃদ্ধ জাম্বুরা পাহাড়ের চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা, ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে জায়গা করে নিয়েছে। চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় রাঙ্গামাটি তে জাম্বুরার বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে কৃষকের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি।
রাঙ্গামাটি জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি চাষিদের বাগানে অনুকূল আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতে চলতি মৌসুমে জাম্বুরা ফলন হয়েছে অন্যান্য বছরে তুলনায় দ্বিগুণ। এতে কৃষকদের মুখে ফুটেছে হাসি। জেলার অনেক স্থানে এই মৌসুমি ফল বিক্রি করে অনেক পরিবারের মধ্যে এসেছে সচ্ছলতা। তবে সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে দ্বিগুণ ঁজাম্বুরা ফলিয়েও দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। পাহাড়ের উপজাতীয় পরিবারগুলো মৌসুম ভিত্তিক অর্থকরী ফল হিসেবে ঘরের আঙিনা বা বাগানের গাছ থেকেই সংগ্রহ করেন পাকা জাম্বুরা। পাকা জাম্বুরা বেশিদিন রাখা যায় না, কারণ ভেতরে পচন ধরে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যসায়ীরা গ্রাম-গঞ্জ থেকেই কমদামে বাগিয়ে নেয় মিষ্টি-টক জাম্বুরা। এ কারণে প্রতি বছর এ জেলায় জাম্বুরার বাম্পার ফলন হলেও বরাবরই ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত থাকেন চাষিরা।
রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলার চাষিরারা জানান, একটি জাম্বুরা চারা লাগানোর ছয় বছরের মাথায় গাছে ফল আসে। এভাবে লাগাতার ১৫ বছর পর্যন্ত মৌসুম ভিত্তিক প্রতিটি গাছে বড় আকারের জাম্বুরা পাওয়া যায় গড়ে ৪শটি করে। ১৫ বছর পার থেকে পরবর্তী ৩০ বছর পর্যন্ত গাছে জাম্বুরার ফলন কমতে থাকে এবং সাইজেও ছোট আকার হয়। প্রতিটি জাম্বুরা গাছ থেকে ছয় বছর থেকে গড়ে ৪শ জাম্বুরা উৎপন্ন হয়। এ হিসেবে প্রতিটি গাছ থেকে উৎপাদিত জাম্বুরার মূল্য দাড়ায় প্রায় ১ হাজার ৬শ টাকা হারে। জেলায় কি পরিমাণ জমিতে জাম্বুরার আবাদ হয়েছে তার সঠিক হিসেব জানা নেই কোনো মহলেরই। তবে চাষিরা দাবি করেন, জেলায় প্রায় ৫ হাজার একরের মত জমিতে জাম্বুরার চাষ হচ্ছে। এসব জমিতে থাকা গাছ থেকে প্রতি বছরই কয়েক লাখ জাম্বুরা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। রাঙ্গামাটি র বিভিন্ন উপজেলার গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত জাম্বুরা খেতে মিষ্টি-টক ও সাদা-লাল রংয়ের। পাহাড়ের জাম্বুরার চাহিদা সারাদেশেই রয়েছে। এ জন্যে এখানকার চাষিরা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছে অর্থকরী ফলদ পণ্য হিসেবে জাম্বুরা বাগানের দিকে।
রাঙ্গামাটির সবচেয়ে বড় মৌসুমী ফলের বাজার শহরের বনরূপাস্থ সমতাঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয় ইঞ্জিন বোটভর্তি জাম্বুরা বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। জাম্বুরাকে ঘিরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের দর কষাকষি চলে। আগে যেখানে স্থানীয় বাজারে প্রতিটি জাম্বুরা ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হতো, সেখানে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫-৭ টাকায়। তবে বড় সাইজের জাম্বুরা ৮-১০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের কুকিমারা গ্রামের জাম্বুরা চাষি ভাগ্যমনি চাকমা জানিয়েছেন, বড় সাইজের একশ গড়ে ১হাজার টাকা এবং মাঝারি সাইজের জাম্বুরা একশটি ৭০০ টাকা হারে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে। বাগান কিংবা বাড়ির আঙিনা থেকেই ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছে এ দামে জাম্বুরা।
জাম্বুরা বিক্রেতা কৃষ্ণ চাকমা জানান, অন্যান্য বছর উৎপাদন কম হলেও দাম ভালো ছিল। গত বছর প্রতিটি জাম্বুরা আকারভেদে ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হতো। চলতি বছর জাম্বুরার উৎপাদন বেশি, দাম অনেকটা কম। জাম্বুরার দাম ৫-৭ টাকায় নেমে এসেছে। ফলে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ী বিকাশ ত্রিপুরা ও মো. নুরুল আলম জানান, বাজারের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামে গিয়েও গাছ থেকে জাম্বুরা সংগ্রহ করেন। যা বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। গত বছর গ্রাম থেকে জাম্বুরা ১০-১২ টাকায় সংগ্রহ করা হতো। এ বছর একই আকারের জাম্বুরা বাজারে ৭-৮ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ী অলি আহাম্মদ বলেন, পাহাড়ের জাম্বুরায় ক্ষতিকর কেমিক্যাল না থাকায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এর কদর বেশি। তবে স্থানীয় বাজারে জাম্বুরার দাম কম হলেও পরিবহন খরচ বেশি।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি বিভাগের সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গামাটিতে চলতি মৌসুমে জাম্বুরার ফলন হয়েছে অন্যান্য বছরে তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের কৃষি বিভাগ হতে কৃষকদের দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির জাম্বুরা চারা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কৃষকরা জাম্বুরা চাষের দিকে ঝুঁকছে।
এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পবন চাকমা জানিয়েছেন, জাম্বুরা ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ লেবু গোত্রের একটি ফল। জাম্বুরার চাহিদা রয়েছে দেশ ও বিদেশে। জাম্বুরার উৎপাদন বেড়েছে। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে জাম্বুরা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। রাঙ্গামাটি জেলায় প্রায় ৭ থেকে ১০ হাজার একরের মতো জাম্বুরা বাগান চাষ হয়েছে। তবে বড় সমস্যা হচ্ছে কাঁচা পণ্য সংরক্ষণে রাঙ্গামাটি জেলার কোথাও হিমাগার নাই ও পাহাড়ি এলাকার যোগাযোগের দুর্গমতার কারণে সঠিক সময়ে বাজারজাত নিয়ে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা। চাষিদের ন্যায্যমূল্য পেতে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আগামীতেও আরো ভালো ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। ভালো ফলনের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।