দুই পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ
অপরাধ করেও পুলিশের গা-ফিলতির কারনে অপরাধী অভিযোগের দায় থেকে খালাস
॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
ভিকটিমকে শাররীক মানসিকভাবে হেনস্থা ও শ্লীলতাহানির চেষ্টা মামলায় অপরাধ প্রমাণে পুলিশের দুই কর্মকর্তা কোন আলামত জব্দ না করা ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করা সহ তদন্তে গুরুতর অবহেলা অদক্ষতা ও অসদাচারণের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে মামলার গঠিত অভিযোগের দায় থেকে আসামীকে মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন আদালত। গত রবিবার (১৭ এপ্রিল) রাঙ্গামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এর বিজ্ঞ বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) এ.ই.এম ইসমাইল হোসেন এই রায় প্রদান করেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, মামলার আসামী জুয়েল (২৫), পিতা- বেলাল, ৬০ সিড়ি এলাকা তবলছড়ি দীর্ঘদিন ধরে ভিকটিমকে উত্যক্ত করে আসত। পরে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর আসামী ভিকটিমকে রাঙ্গামটি শহরের আসামবস্তীস্থ নারিকেল বাগান হর্টিকালচার মসজিদের নির্জনস্থানে ভিকটিমকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়া সহ শাররীক ও মানকিভাবে হেনস্থা এবং ইভটিজিং করে। পরে ভিকটিমের আত্মচিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে প্রানে রক্ষা পায়। ঘটনার পর ভিকটিম সহ তাঁর পিতা ঐ দিন সন্ধ্যায় কতোয়ালী থানায় অভিযোগ দায়ের করলে অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হিসেবে রুজু করে। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এস.আই মোঃ আনোয়ার কামাল হারুন।
এদিকে আদালত সুত্র জানায়, বিজ্ঞ আদালতের রায়ের সারাংশে আসামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সংক্ষিপ্ত বিবরণে উল্লেখ করেন, আসামী জুয়েল পূর্ব পরিচয়ের সুত্র ধরে বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেয়া, শাররীক ও মানসিকভাবে হেনস্থা সহ ইভটিজিং করে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৭/১০/২০১৯ইং সালে আনুমানিক সন্ধ্যা ছয় ঘটিকার সময় এজাহারকারীর মেয়ে ব্যক্তিগতকাজে বের হলে তবলছড়ি ব্রীজের উপর আসলে আসামী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পিছন দিক হতে সিএনজি যোগে এসে তার মুখ চেপে ধরে তাকে জোরপূর্বক সিএনজিতে উঠিয়ে অপহরণ করতঃ তবলছড়ি আসামবস্তিস্থ নারিকেল বাগানের ভিতরে হর্টিকালচার মসজিদের ডানপাশে অন্ধকার স্থানে নিয়ে যান। সেখানে আসামী ভিকটিমের কাপড়চোপর খুলে শ্লিলতাহানীর চেষ্টা করলে ভিকটিম বাঁধা দেয়। আসামী তখন ভিকটিমকে কিলঘুষি ও তলপেটে আঘাত দিয়ে তার শারীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম করে। ভিকটিমের চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে আসামী ভিকটিমকে আহত অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায়। ভিকটিমের পিতা ঐ দিনই থানায় মামলা দায়ের করেন। ভিকটিম পরবর্তীতে আদালতে এসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ২২ ধারা মোতাবেক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে জবানবন্দী দেন।
বিজ্ঞ আদালত মামলার তদন্তের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, কতোয়ালী থানার এসআই মোঃ আনোয়ার কামাল হারুন মামলাটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি বদলী হলে এসআই মোঃ জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি তদন্ত করেন এবং আসামীর বিরুদ্ধে ভিকটিমের অপহরণ ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৭ ও ৩০ ধারায় অভিযোগ দাখিল করেন। বিচার কার্যক্রমের ৮জন সাক্ষী উপস্থাপন করে। উক্ত সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদ্বয় মামলা তদন্তে অমার্জনীয় অদক্ষতা ও গাফিলতি করেছেন।
বিজ্ঞ আদালত রায়ে আদেশ করেন যে, আসামী জুয়েল (২৫), পিতা- বেলাল, ৬০ সিড়ি এলাকা, গ্রাম তবলছড়ি, থানা কোতয়ালী, জেলা- রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাকে এই মামলায় গঠিত অভিযোগের দায় হতে খালাস প্রদান করা হল। সেই সাথে এই মামলার অপরাধ প্রমাণের ব্যবহারযোগ্য আলামত জব্দ না করা, অপহরণের ঘটনাস্থলের খসড়া মানচিত্র প্রস্তুত না করা, ভিকটিমের ডাক্তারী পরীক্ষা সম্মপন্ন না করা এবং গুরুত্বপূর্ন স্বাক্ষীদের পরীক্ষা না করাসহ তদন্তে গুরুতর অবহেলা করার কারণে কোতয়ালী থানার এসআই মোঃ আনোয়ার কামাল হরুন এবং এসআই মোঃ জাহাঙ্গীর আলম এর বিরুদ্ধে অদক্ষতা ও অসদাচারণের দায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৮(৮) ধারা মোতাবেক শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের নিয়ন্ত্রকারী কর্তৃপক্ষকে নিদেশ দেয়া হল।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামলার রায়ে সংক্ষুব্ধ। তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে আসামী খালাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন। অপর দিকে আসামী পক্ষের আইনজীবী মোখতার আহম্মদ রায়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করে বলেন, বাদীপক্ষ ঘটনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত আসামীকে খালাস দেয়।
অন্যদিকে ভিকটিমের পরিবার এই রায়ে হতাশ প্রকাশ করেছেন। অপরাধী অপরাধ করলেও তদন্তে পুলিশের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মামলার তদন্তকারী প্রথম কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করার পরও ঘটনার নানান আলামত জব্দ গ্রহন না করেই আদালতে দায়সারাগোচের তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। যার কারনে অপরাধীর সাজা না হয়েও খালাস হয়েছে। এই রায়ে ভিকটিমের পিতা বলেন, আমিও হতাশাগ্রস্ত হলাম। শুধুমাত্র তদন্তকারী কর্মকর্তার কারনে অপরাধীর সাজা না হয়ে খালাস পেয়েছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র পক্ষের এবং আসামী পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যের এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আসামী অপরাধ করেও তদন্তকারী কর্মকর্তার কারনে খালাস পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, তদন্তকারী প্রথম কর্মকর্তা ঘটনার পর তদন্তে গিয়ে ভিকটিমকে যিনি বাঁচিয়েছেন তিনি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের কর্মচারী মোঃ হারুন ও পরে যিনি ছিলেন তিনি হলেন মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত মোঃ সাদ্দাম হোসেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের নাম ঠিকানা সব নিয়েও তাঁর প্রতিবেদনে বাদ দিয়েছেন অথচ যিনি ছিলেন না অর্থাৎ হর্টিকালচার উদ্যান কর্মকর্তা মোঃ কামালকে সাক্ষী হিসেবে দিয়েছেন। সুতরাং এ ধরনের পুলিশ কর্মকর্তার কারণে অপরাধীর সাজা না হয়ে উল্টো অপরাধ করার সাহস যোগাবে। অন্যদিকে ভিকটিমকে সে দিন পানি খাইয়ে রক্ষা করলেও জোৎস্না বেগম আদালতে বলেছেন তিনি শুনেছেন।