মানিকছড়িতে আবারও বসছে ঐতিহ্যবাহী ‘মহামুনি বৌদ্ধ মেলা’
॥ মোঃ ইসমাইল হোসেন, মানিকছড়ি ॥
প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে ঘিরে থাকে নানা আয়োজন। তবে গেল দুবছর করোনা ভাইরাসের কারণে ছিল না কোনো আয়োজন। পারিবারিক ভাবে পালিত হয়েছে উৎস। কিন্তু এ বছর যেহেতু করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর কমেছে তাই সারাদেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ ও বিদায়ের নানা প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। চলছে ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ। তবে বর্ষ-বরণ ও বিদায়কে ঘিরে পার্বত্যঞ্চলে আনন্দের এক ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। কেননা এ অঞ্চলের পাহাড়ী-বাঙ্গালী সকলে মিলে বর্ষবরণের সকল আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। প্রায় দেড়শ বছর ধরে মানিকছড়ি উপজেলাধীন মহামুনিস্থ ‘বৌদ্ধ মন্দির’ টিলায় বর্ষবরণে বসে পার্বত্যঞ্চলের সব চাইতে বড় মেলা। মেলার সকল আয়োজন উপভোগ করতে তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রামসহ সারা দেশের হাজারো নর-নারী, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সমাগম ঘটে। পরিণত হয় পাহাড়ী-বাঙ্গালী সকল সস্প্রদায়ের মিলন মেলায়। প্রতি বছর ১৩ এপ্রিল বিকালে পুরনো বছরকে বিদায় ও পহেলা বৈসাক’কে স্বাগত জানিয়ে মারমা উন্নয়ন সংসদ’র উদ্যোগে বের হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এতে হাজার হাজার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন নানা সাঁজে সজ্জিত হয়ে ও বিভিন্ন ব্যানারে নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরেন। তবে টানা দ্বিতীয়বারের মত করোনার থাবায় বসছে না মহামুনি বৌদ্ধ মেলা। এবার বসছে এর ১৩৯তম আসর।
এ অঞ্চলের তৎকালীণ রাজা নিপ্রুসাইন (১৮৮৪-১৯২৯) রাজত্বকালের শুরুতে মানিকছড়ি রাজ প্রসাদের মানিকছড়ি খালের ওপারে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশের্^ মহামুনি টিলায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহামুনি বৌদ্ধ মন্দির। সেখানে প্রতিবছর মেলা বসে। এ মেলাকে কেউ সাংগ্রাই, বৈসাবি, বৈসাবিন মেলা ও বৈশাখী মেলা বলে থাকে। মূলত এটি ‘মহামুন বুদ্ধ মেলা’। মহামুনি টিলায় বুদ্ধ মূর্তি স্থাপনের পর থেকেই এ মেলার সূচনা হয় বলে জানা গেছে। ১৭৮৪ সালে মায়ানমার (বার্মা) আরাকান থেকে মূর্তি এনে মংসার্কেলের মংরাজা কংজয় বাহাদুর চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ‘মহামুনি’ নামক বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করেন। এরপর ১৮৮৩ সালে আরেক মংরাজা বাহাদুর নিপ্রুসাইন মানিকছড়িতে ‘মহামুনি’ বুদ্ধ মূর্তিটি মায়ানমার (বার্মা) মান্দালয় প্রদেশ থেকে অষ্ট ধাতু দিয়ে তৈরি করে মূর্তিটি নিয়ে এসে উপজেলা সদর চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ির সড়কের পাশের্^ মহামুনি টিলায় স্থাপন করেন। তখন থেকে এ মহামুনি টিলায় প্রত্যেক বছর মারমা পঞ্জিকা অনুসারে এ মেলা বসে প্রথম দিকে মেলা জাকঁজমক হয়ে না উঠলেও আশির দশকের পর থেকে জাকঁজমক হয়েছে উঠে। বর্তমানে পার্বঞ্চলে সব চেয়ে বড় মেলা হিসেব মনে করা হয়। মহামুনি মেলা হওয়া মূল উদ্দেশ্য হল ‘মহামুনি’ বুদ্ধ মুর্তি স্থাপনের বর্ষপুর্তি। তবে মেলার দিন পঞ্জিকা থাকলেও অনেক সময় ইংরেজি ১৪ এপ্রিলের সাথে মিলে যায় বলে অনেকে মনে করেন এটি বৈশাখী মেলা।
মূলত মারমা জনগোষ্টির আয়োজনে এ মেলা বাস্তবায়ন হলেও সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাহাড় পেরিয়ে সমতল থেকেও হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মূখরিত হয় ওঠে মহামুনি টিলা। নানা বয়সী মানুষেরা পহেলা বৈশাখকে ‘স্বাগতম বাংলা নববর্ষ, এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ এসব স্লোগানে লেখা ক্যাফ, পে-কার্ড মাথায় দিয়ে মেলায় ঘুরে বেড়ান। এছাড়াও মন্দিরে ভক্তরা দিনব্যাপী পূজা-পর্বনায় ব্যস্ত থাকেন। তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরদের বাঁধভাঙ্গা আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকেন। মেলায় উপজাতি জনগোষ্টির রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন খেলাধুলাসহ প্রচলিত সকল পণ্য সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন সহস্রাধিক ব্যবসায়ী। প্রশাসন ও মেলা উদযাপন কমিটির কড়া নজরধারী কারণে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা লক্ষ করা যায় না।
মেলা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক উলাচাই মারমা জানান, মেলাকে কেন্দ্র করে উদযাপন কমিটির সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের স্বেচ্ছাসেবকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরাও সার্বিক নিরাপত্তায় থাকেব। আশা করি মেলাকে ঘিরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। তাই সকল ধর্মে সর্বস্তরের জনসাধারণকে মেলা আসার আহব্বান জানান তিনি।
মেলায় নির্বিগ্নে দর্শনার্থীদের ঘোরাফেরা এবং কোনো প্রকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি না ঘটে সে লক্ষে কঠোর অবস্থানে থাকবে পুলিশ বাহিনী এমনটাই জানিয়েছেন মানিকছড়ি থানার ওসি মোহাম্মদ শাহানূর আলম।