নিজস্ব মাতৃভাষা ও অক্ষরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করব- সর্বমিত্র চাকমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে অংশ নেয়ায় বেশ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন রাঙ্গামাটির মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী সর্বমিত্র চাকমা। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী হয়ে ৮ হাজার ৯৯৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। রাঙ্গামাটির লেকার্স পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০২০ সালে এসএসসি পাশ করে ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ২০২২ সালে এইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর অনুভুতি, অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পাহাড়ের সময় এর বিশেষ প্রতিনিধি বিহারী চাকমা।
পাহাড়ের সময় ঃ ডাকসুর নির্বাচনে আপনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। ভাল আছেন?
সর্বমিত্র ঃ হ্যাঁ, ভাল আছি। আপনাদের আর্শীবাদেই আমি ডাকসুর কার্য নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হয়েছি।
পাহাড়ের সময় ঃ অনেকে বলছেন আপনি ছাত্র শিবিরের প্যানেলে নির্বাচন করছেন মানে শিবিরের সদস্য হয়েছেন। সত্যিই কি আপনি ছাত্র শিবিরে যোগ দিয়েছেন?
সর্বমিত্র : এক কথায় উত্তর “না”। আমি ছাত্রশিবিরে যুক্ত হইনি। ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার মূল শর্ত হলো ইসলাম ধর্মের অনুসারী হতে হবে। সেই জায়গায় একজন অমুসলিম তথা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়ে ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার প্রশ্নই আসে না। মূলত আমি ছাত্র শিবিরের সাথে একটি নির্বাচনী জোট করেছি মাত্র। যেমনটা আদর্শের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সাথে নির্বাচনী জোট করেছিল কিংবা বিএনপি ২০০১ সালে। খেয়াল করে দেখবেন আমাদের নির্বাচনী জোটের নাম ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট” জোট শব্দের অর্থ ভিন্ন মতাদর্শের, ভিন্নধারার মানুষ একটি সাধারণ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়। আমাদের জোটে আমি ছাড়াও অনেক অংশীদার আছেন যারা ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত নন।
পাহাড়ের সময় ঃ ছাত্র শিবিরের প্যানেলে কেন? অন্য প্যানেলে কেন করেননি ?
সর্বমিত্র : আমাদের কাছে প্যানেল জিনিসটি খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় একই সাথে একটি নির্বাচনী কৌশল। যেমন উদীয়মান রাজনীতিবিদ রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা এনসিপি’র রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও তার দল বাগছাসের প্যানেল থেকে নির্বাচন না করে উমামা ফাতেমার প্যানেল থেকে নির্বাচন করেন। এটা স্রেফ একটি নির্বাচনী কৌশল। আমি শুরু দিকে বাম জোট, উমামা ফাতেমার স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যসহ বিভিন্ন প্যানেল থেকে প্রস্তাব পাই। পরে বিচার বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলে যুক্ত হলে জয়ের সম্ভাবনা ও কাজ করতে পারার স্বাধীনতা থাকবে তাই আমি এই প্যানেলে যুক্ত হয়েছি। ডাকসু মূলত একটি স্বল্প মেয়াদের একটি দায়ভার, যেটি মূলত পরিচালিত হয় শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়কে কেন্দ্র করে। ডাকসু দলীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জায়গা নয়।
পাহাড়ের সময় ঃ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও তো দাঁড়াতে পারতেন। প্যানেল কেন?
সর্বমিত্র ঃ দেখুন আমরা অনেক সৎ স্বতন্ত্র এমপিকে দেখেছি বিগত সময়ে। তাদের দলীয় প্রভাব না থাকার কারণে সৎ হওয়া সত্ত্বেও এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারেননি। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমার মনে হয়েছে কাজ করতে হলে একটি শক্তিশালী প্যানেল দরকার।
পাহাড়ের সময় ঃ পাহাড়ি ছাত্রদের অনেক সংগঠন আছে বাংলাদেশে। জেএসএস, ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ছাড়াও জাতিগতভাবে মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, পাংখোয়া ছাত্রদের ছাত্র সংগঠন আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কমিটিও আছে। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে এসব ছাত্র সংগঠন ডাকসু, জাকসু নির্বাচনে এককভাবে বা অন্য দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারতো। তারা তা করেনি বলেই মনে হয়েছে। আপনার মতামত কি?
সর্বমিত্র ঃ এটা তাদের দলীয় আভ্যন্তরীণ বিষয়। আমি যতদূর শুনেছি বিভিন্ন প্যানেল তাদের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছে। ক্যাজুয়ালি করেছেও। আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ছাত্র সংগঠন হিসেবে তারা অন্য দলের সাথে আলোচনা করতেই পারে। এটা একান্তই তাদের সাংগঠনিক বিষয়। কিন্তু তারা কোনো জোট করেছে কিনা সে ব্যাপারে আমি জানি না। আমি লোকমুখে শুনেছি ডাকসুর নবনির্বাচিত সদস্য হেমা চাকমার পরিবার ইউপিডিএফের রাজনীতির সাথে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউপিডিএফের পিসিপি দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থীদের সাথে “গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটে” আছে। সেদিক থেকে হেমা চাকমা বামদের “প্রতিরোধ পর্ষদ” প্যানেলে যুক্ত হয়েছে এমনও হতে পারে। তবে সুস্পষ্টভাবে আমার কাছে এ বিষয়ে কোন তথ্য নেই।
পাহাড়ের সময় ঃ ছাত্র শিবিরের প্যানেলে আসার পর চাপে পড়েছেন কি?
সর্বমিত্র ঃ আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অনেক সহজ সরল। জটিল বিষয় আমরা জাতিগতভাবে এড়িয়ে চলি। যার কারণে অনেকের ধারণা আমি শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। এজন্য অনেক কটু কথার শিকার হয়েছি। এখনো হচ্ছি। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
পাহাড়ের সময় ঃ সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ সেটা একটু খুলে বলুন।
সর্বমিত্র ঃ আমি যেরকম কটু কথার শিকার হয়েছি, আমার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল অন্যদেও ক্ষেত্রে তেমনটা আমি দেখিনি। ছাত্রদলের প্যানেল বাংলাদেশপন্থী শিক্ষার্থী ঐক্য থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয়া চিমচিম্যা চাকমার নির্বাচনী ছবিটি হয়ত দেখেছেন। তার বৌদ্ধ শ্রমণ অবস্থায় চীবর পরা ছবি নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়েছে। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বা শ্রামণ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হতে পারেন না। ইনক্লুসিভিটি দেখানো হলেও সেখানে বৌদ্ধ ধর্মকে এক প্রকার হেয় করা হয়েছে। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলেনি। কথায় আছে শক্তের ভক্ত-নরমের যম। আমার ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই।
পাহাড়ের সময় ঃ কি কি কাজ করতে চান নিজ জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য?
সর্বমিত্র ঃ নির্বাচনী প্রচারণার সময় এক সাক্ষাৎকারে চাকমা ভাষায় ভোট চেয়েছিলাম। ভালোভাবে চাকমা ভাষাটা হয়নি তা বলে অনেকে সমালোচনা করেছেন। সে সমালোচনা আমি পজিটিভলি নিয়েছি। আমার উপলব্ধি হয়েছে আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজস্ব মাতৃভাষা ও অক্ষরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। তাই আমি পরিকল্পনা করছি আমাদের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ যে সকল জনগোষ্ঠীর বর্ণমালা ও ভাষা আছে সেই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে বাধ্যতামূলক নিজ মাতৃভাষার উপর কয়েক মাসব্যাপী কোর্স রাখা। এতে করে আমাদের ভাষা-বর্ণমালা বেঁচে থাকবে। নিজের জাতির প্রতি আমার যথেষ্ট টান ও শ্রদ্ধা আছে। সে জায়গা থেকে আমি জাতির জন্য নীরবে কাজ করে যেতে চাই।
পাহাড়ের সময় ঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।