বান্দরবানে ভিক্ষু ড. এফ দীপংকর মহাথের হত্যা, বৌদ্ধরা কি অসহায় ?
॥ শ্রী শুভ শংকর ॥
পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে গহীন অরণ্যে যাঁরা ধ্যান সাধনায় রয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ড. এফ দীপংকর মহাথের যাঁকে ধুতাঙ্গ ভান্তে, বৌদ্ধ সমাজে আর্যসত্য পুরুষ ধর্মগুরুভান্তে বলেও পরিচিত। যদ্দুর মনে হয় বুদ্ধ শাস্ত্র মতে যেসব ভিক্ষু যেসব অরণ্যে জনমানুষের দেখা মেলেনা সেসব অরণ্যের গুহায়, গাছ তলায় বা খোলা আকাশের নিচে আবার নির্জন খোলা শ্মশানে নিজের লক্ষ্য কিংবা মুক্তির পথ খুঁজতে দিন-রাত, ঝড়-তুফান, প্রচন্ড গরম-শীত, ক্ষুধা-নিদ্রাকে উপক্ষো করে বছরের পর বছর ধ্যান সাধনায় রত থেকে লক্ষ্য অর্জন করেন তাঁকে ধুতাঙ্গ ভান্তে বলে ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমাজে। ধ্যান সাধনার স্থানকে কেন্দ্র করে তাঁকে অরণ্যচারী, শ্মশানচারী বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সম্বোধনও করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ভিক্ষুর মধ্যে যিনি কঠোর থেকে কঠোরতম ধ্যান-সাধনা এবং সত্যের সন্ধানে নিজেকে ৬বছরের অধিক সময়ই ঝড়, তুফান, বৃষ্টি, প্রলয়, হিংস্র ও বিষধর প্রাণী সাপ, হিংস্র প্রাণী বাঘ, শিয়াল, নেকড়ে ও ভাল্লুকের ভয়কেও জয় করে বনে জঙ্গলেই নিজেকে বছরের পর বছর ধ্যানে নিমগ্ন করে রেখেছিলেন। তিনিই বৌদ্ধ সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর কাছে মহৎ সাধক হিসেবে পরিচিত ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আর্যপুরুষ বা সত্যবাদী বলে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন তিনি হলেন ধুতাঙ্গ ভান্তে ড. এফ দীপংকর মহাথের। যাকে গত বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১২ জুলাই রাত গতে বান্দরবানের গোদারপাড় এলাকার অরণ্যে অবস্থিত বান্দরবান আর্য্যগুহা ধুতাঙ্গ বিমুক্তি বিহারের নির্জন কুঠিরে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে দঁড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
তাঁর পরিচিতিতে দেখি ড. এফ দীপংকর মহাথের এঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামের ফটিকছড়িস্থ ফরাঙ্গীখিল গ্রামে। তাঁর বাবা (নান্টু বড়ুয়া) ছিলেন একজন স্বল্প আয়ের মানুষ যিনি কিনা ঘরবাড়ি তৈরীর কাজ করতেন। ৬ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সেজ সন্তান গৃহী নাম ছিল দীপংকর বড়ুয়া। বাবার কাজের সুত্রে ১৯৮৫ সালে ভেদভেদী গ্রামে আসলে তাঁর শিশুকাল এবং প্রাথমিক শিক্ষা ভেদভেদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় থেকে ৫ম এবং মাধ্যমিকে রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এই লেখক ছিলেন প্রয়াত ড.এফ দীপংকর মহাথের এঁর শিশুকালের খেলার সাথী খেতেনও একসাথে। কিছু বছর পরে গ্রামে ফিরে গিয়ে ১৯৯১ সালের ১৭জুন প্রবজ্যা গ্রহন করেছিলেন নিজ গ্রামের গৌতমমুনি বৌদ্ধ বিহারে। সেখানেও পড়াশুনায় ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হলে ক’মাস পর মেজভাই সহ এই লেখক শ্রী শুভ শংকর তাঁকে রাউজানের মহামুনি গ্রামের মহামুনি সংঘরাজ বিহারের অধ্যক্ষ যিনি আজকের বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা’র উপসংঘরাজ ধর্মপ্রিয় মহাস্থবীর এঁর হাতে তুলে দেন। অতঃপর শিক্ষা জীবনের উন্নতির ধাপ শুরু হয়। ১৯৯২ সালে মহামুনি এ্যাংলো পালি উচ্চ বিদ্যালেয় ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করেন, ১০ম শ্রেণীতে উত্তির্ণ হয়ে কুমিল্লা বোর্ড এর অধীন ১৯৯৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ১ম শ্রেণী, ১৯৯৬ সালে ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতে ২য় শ্রেণী অর্জন করেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি চলে যান ভারতে। সেখানের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত কলেজ কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে বিএ অনার্স পরীক্ষায় ১ম শ্রেণী অর্জন করেন এবং একই কলেজ থেকে ২০০২ সালে এমএ ১ম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করলে মেধা ভিত্তিক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন এবং পরে সেখান থেকে ২০০৪ সালে ভারত সরকারের ওঈঈজ (ওহফরধহ পড়ঁহপরষ ভড়ৎ পঁষঃঁৎধষ ৎবষধঃরড়হ) কর্তৃক স্কলারশিপ লাভ করে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.বেলা ভট্টচার্যের তত্ত্বাবধানে চঐ.উ ডিগ্রি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। যার গবেষণার বিষয় ছিল ঝড়পরড়-ৎবষরমরড়ঁং পড়হফরঃরড়হ ড়ভ ধহপরবহঃ ওহফরধ ধং ফবঢ়রপঃবফ রহ ঃযব রহংপৎরঢ়ঃরড়হং ড়ভ অংড়শধ. এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে ২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর স্বদেশ (বাংলাদেশ) প্রত্যাবর্তণ করেন।
তাঁর লক্ষ্য ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ও ধর্ম প্রচার-প্রসারে ধ্যান সাধনায় দুঃখমুক্তি, সর্বোপরি পরিনির্বাণ লাভ করা। তাই নিজের লক্ষ্যকে দৃঢ়তার সাথে অর্জন করতেই ২০১২ সালে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ধুপপানিছড়াস্থ গহিন অরণ্যের গুহায় ১ম ধ্যানীবর্ষ সমাপ্ত করেন, ২০১৩ সালে একই উপজেলার ধুশীলস্থ মহাশ্মশানের নিচে নির্জন ভয়ংকর পরিবেশে ২য় ও ২০১৪ সালে একই শ্মশানের উপরে চরম বিপর্যয়ের মুখে ৩য় ধ্যানীবর্ষ পরে ২০১৫ সালে জুরাইছড়ি উপজেলার হাতিমারাস্থ ঢেবাছড়ার নির্বাণ গুহায় ৪র্থ এবং ২০১৬ সালে বান্দরবানের সদরের গোদারপাড়স্থ গহীন অরণ্যের গুহায় ৫ম ও ২০১৬ সালে সেখানেই ৬ষ্ট ধ্যানীবর্ষ সম্পন্ন করেন। এরই মধ্যে লোকালয়ে পিন্ডচারণ সহ ধর্ম দেশনায় আসলে পাহাড়িদের কাছে একজন আর্যপুরুষ হিসেবে পরিচিত হন। তিনি সকল প্রাণীর কল্যানে নিজেকে নিমগ্ন রাখতেন ধ্যান সাধনায়, ধর্ম দেশনায়। ভিক্ষু জীবনে তিনি সুদীর্ঘ ৩৩বছর ২৭দিনের ধুতাঙ্গ সাধনায় দেশে বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এভাবেই রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে তাঁর হাজার হাজার ভক্তকূলে জয়জয়কার হতে থাকে এবং দেশ-বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে বৌদ্ধ ও ভিক্ষু সমাজের একজন আর্যপুরুষের পরিচয়ে।
তাঁর এই সুনামকে মেনে নিতে পারেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদেরই লোক ও ধর্ম সমাজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা মানুষরূপী রাক্ষস খোক্ষসের দল। তাই ষড়যন্ত্র করে ক্রমাগত নানান ফর্দের অত্যাচার, মিথ্যের বিষবৃক্ষের গঁজিয়ে পড়া ডালপালার লাগাতার বিষ ছড়ানো। তাই তাঁকে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্মপ্রিয় আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বয়ং বুদ্ধের পরিচয়কেও পদদলীত করে বাঙ্গালি বড়ুয়া ভিক্ষু, ভারতের গুপ্তচর তকমা লাগিয়ে, বহুবার হত্যা চেষ্টা সহ নানান ষড়যন্ত্র কোন কাজে আসছিলনা তাঁকে লালনপালনকারী পাহাড়েরই বৌদ্ধ জনগোষ্টীর তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, চাকমা, খিয়াং, ম্রো, বড়ুয়া, হিন্দু ও মুসলিম সমাজের মানুষের প্রতিবাদের কারনে। সমাজের মানুষগুলোর বিশ^াস ধুতাঙ্গ ভান্তের দ্বারা বুদ্ধের ধর্ম প্রচার, সত্যের সন্ধানে, সত্য প্রতিষ্ঠায় কঠিনভাবে নিজেকে আভির্ভুত করায় সমাজের মানুষগুলো তাঁর আশির্বাদপ্রাপ্ত হয়ে বিপদ-আপদ, রোগ-বালাই থেকে মুক্ত থাকা, সর্বোপরি বুদ্ধের ধর্ম রক্ষা এবং প্রচার প্রসারের কাজে দায়িত্ব পালনে একাট্টা থাকায় সুযোগ পাচ্ছিল না ধুতাঙ্গ ভান্তেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে। কিন্তু আঘাত করতে থাকলেও ড. এফ দীপংকর মহাথেরকে কোনভাবেই পরাস্ত করতে পারেনি। এর পরও মিথ্যের জাল বুনেই গেছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
বুদ্ধের ধর্মকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী পুঁজিপতি বনে যাওয়ারা ভিক্ষের পাত্র কেড়ে নেওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকী নিত্য তাড়া করেছিল ড.এফ দীপংকর মহাথেরকে। কিন্তু এই আর্যপুরুষকে হাজার হাজার মিথ্যের তকমা দিয়েও সত্যের পথ থেকে নড়বড়ে করতে পারেনি। পারেনি বুদ্ধের ধর্ম প্রচার প্রসারের কাজকে, নত করতে পারেনি তাঁর ভক্তকূল সাধারণকেও। তাই রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িস্থ ধুপশীল মাহশ্মশান এলাকা সহ ফারুয়ার সকল গ্রামে, জুরাইছড়ির নির্বাণ গুহা, গুইছড়ি এবং বান্দরবানের গোদারপাড়স্থ আর্যগুহা ধুতাঙ্গ বিমুক্তি বিহার সহ সেখানকার গ্রামের আদিবাসী ভক্তরা আর্যপুরুষের সাঙ্গ ছাড়েনি তাঁর আশির্বাদের ছায়ায় থাকার জন্য। ধুতাঙ্গ ভান্তে এঁর প্রদত্ত সকল ধর্মদেশনায় সত্য প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠায় যুক্তিবাদী ধর্ম প্রচার নিখুঁত ধর্মশৈলীর ছোঁয়ার বাঁধনে তারা বাধিত। ধুতাঙ্গ ভান্তে ধর্মদেশনায় বলেছিলেন নারিকেল ‘পানি আর মজ্জাকে’ ধরে রাখতে উপরের আবরণকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে রাখে, ঠিক আমিও বুদ্ধের সত্যকে, ধর্মকে ধরে রাখতে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছি। বনের বানর বনের গাছের ডাল-পালাগুলো ভাঙ্গে না, হত্যা করেন কেননা সে চলাফেরা করতে, খেতে, খেলতে এবং বাঁচতে পারবে না বলে, এটাই হলো বানরের ‘ধর্ম’। বুদ্ধের ধর্ম, ত্রিপিটক এবং তাঁর সুত্রগুলো ধর্ম ও মানব সমাজ সহ সকল সম্পদ-সম্পর্ক রক্ষার এক-একটি মজবুত শাখা প্রশাখাও, অথচ আমাদের ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমাজ প্রতিনিয়ত বুদ্ধের ধর্মের এই শাখা-প্রশাখাগুলো নিত্য ভাঙছে, হত্যা করছে তাহলে এটা কি সত্যি যারা এসব করছে তাদের মধ্যে বানরের মত গুণও নেই? তাই মানব জাতির কল্যাণে বুদ্ধের ধর্ম রক্ষা করতে আমিও কঠিন হয়েছি, এতে আমার মৃত্যুও হতে পারে। বুদ্ধের কর্মবাদী ধর্মই চিরসত্য এই প্রতিষ্ঠিত সত্যের কাছে হিংসা ও মিথ্যের মৃত্যু হবেই পদে পদে। ভক্তকূলের কাছে ধুতাঙ্গ ভান্তে ছিলেন স্বয়ং আর্য্যপুরুষ বৌদ্ধ ভিক্ষু যাঁর কাছে মিথ্যের কোন ছোঁয়া-স্থান ছিল না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধ অঞ্চল হিসেবে দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরিচিতি ও খ্যাতি রয়েছে। সেই বৌদ্ধ অঞ্চলে একজন গেরুয়াবসনধারী সাধক ভিক্ষুকে রাতের আঁধারে শাররীরকভাবে চরম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে কিসের, কার এবং কাদের স্বার্থে এসব প্রশ্নের জবাব চাইতে পারছেনা তাঁর ভক্তকুলরা। বৌদ্ধ অঞ্চল বলে সরকারগুলোর দেয়া অর্থে, জনগনের দানের টাকায় বৌদ্ধ বিহার তৈরী, ইয়া বড় বড় বুদ্ধের মুর্তি, হাজারো গেরুয়া বসনধারী, চাকচিক্য বিহার বানানোর প্রতিযোগীতার দেশে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষমতাধর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের দেশে একজন ভিক্ষুকে হত্যা করা হলেও পাহাড়ের ধর্মব্যবসায়ী, ভিক্ষু কর্তৃত্ববাদীরাও মুখে কুলুপ সাঁটিয়েছে, এই ভেবে যে প্রতিবাদ করলে ধর্ম ব্যবসা, দেশী-বিদেশীর দানের অর্থে চলা ভোগবিলাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। বৌদ্ধ সমাজের, ভিক্ষু সমাজের আড়ালে, ধর্মের নামে ব্যবসায়ী সমিতি-কমিটি গুলোর আড়ালে হিংসা আর মিথ্যে তৈরীর চাষীরা যখন মানুষের মঙ্গল কামনা করে তখন চিত্তের দর্পণে আঘাতের ধ্বনির সৃষ্টি কি হয় না ? আসলে ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে বুদ্ধ ধর্মের প্রজ্ঞার শাসন অনুপস্থিত কেননা ধর্মকে যারা ব্যবসায় রূপান্তর করে পুঁজিপতি বনে যাওয়ারাতো এ ভিক্ষু হত্যার বিচার চাইবেনা। ফলত ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের হীন লক্ষ্য নিয়েই সমাজে লুকিয়েছিল বিভিন্ন ছলনায়, ছদ্মাবরনে আর সুযোগের সন্ধানে। তাই ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা সরকার হঠানোর আন্দোলন চলাকালীন সময়কে সুযোগ করে নিয়ে ১২ জুলাই রাতের কোন এক সময় ধুতাঙ্গ ভান্তে ড. এফ দীপংকর মহাথেরকে বর্বর নির্যাতন ও হত্যা করে তাঁরই কুটিরে দঁড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল খুনিরা। তার পরে হুমকি দিয়েছে তাঁর শিষ্য যারা বড়ুয়া ভিক্ষু রয়েছে তাদেরকেও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বের করে দিতে হবে, না হলে তাদেরও একই দশা হবে। অতঃপর শিষ্য যারা বড়ুয়া ভিক্ষু রয়েছে তাদেরকে ঠিক তাই-ই করা হলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিক্ষু সমাজের কর্তৃত্ববাদী, বিহার কমিটির, বৌদ্ধ সমিতির নেতৃত্ববাদীরা এই হত্যার বিচার চাইতে সাহস পাননা এই ভয়ে যে তাদেরকেও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যেতে হবে অথবা মরতে হবে।
লক্ষ্য করলে দেখি গহীন বনে জঙ্গলে ধ্যান সাধনা করলেও বনের বিষধর সাপ, হিংস্র বাঘ-ভাল্লুক বা অন্য হিংস্র কোন প্রাণীই ড. এফ দীপংকর মহাথেরকে বিষ প্রয়োগ করতে আসেনি, প্রাণ নিতে আসেনি বরং ধ্যান সাধনায় তাঁকে তারাই পাহাড়া দিয়ে রেখেছিল, কেননা সকল প্রাণীর কল্যানে তিনি বুদ্ধের আর্য্যসত্যকে ধারণ করেছিলেন বলে। কিন্তু অধার্মিকরা কি শোনে ধর্মের কাহিনী, পরিস্থিতি হয়েছে যেন এমন। বনের নয় বরং মানব সমাজের হিংস্র এবং বিষধরদের হিংস্রতা, বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্র লালনপালনকারীরা চরম নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করেই ছাড়ল। ধর্মযুদ্ধ করেও অবশেষে আর্য্যসত্যের পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, ভক্তরাও তাঁকে বাঁচাতে পারেননি অথবা প্রানের ভয়ে চেষ্টা করেন নি। এই আর্য্যপুরুষকে যারা হত্যা করেছে কর্মফল ভোগ করতেতো হবেই, শত শত পুঃনপুঃন জন্ম নিতেই হবে পাপের প্রাশ্চিত্ত করতে। হতাশাগ্রস্ত ভক্তরাও এখন বলে অনেক বড় বড় রঙিন ও স্বর্ণ আভায় কারুকাজ সম্বলিত বিহার করা হয়েছে, কর্তৃত্ববাদী ভিক্ষু রয়েছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ধার্মিক, দানবীর নামের বড় বড় নেতাও রয়েছে। কিন্তু কি লাভ হচ্ছে বা হয়েছে যেখানে স্বয়ং আর্য্যপুরুষ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করা হয় রাতের আঁধারে আবার এই হত্যার বিচারও চাওয়া হয় না। তাই দেশে-বিদেশে বিজ্ঞ প্রাজ্ঞরা কি প্রশ্ন করবে না বুদ্ধের অহিংসাই পরম ধর্ম কি পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে ? এত এত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্ম চর্চা হয়, কিন্তু ধার্মিক কি হয়েছে ? সত্যি অহিংসাই পরম ধর্ম এখানে নেই। যা আছে তা হয়তো শুধু খোলসপড়া তাই যদি না হয় একজন ভিক্ষুকে, আর্য্যপুরুষকে কিভাবে হত্যা করা হয়।
ধুতাঙ্গ ভান্তে ড. এফ দীপংকর মহাথেরকে হত্যার এক বছর অতিক্রম হতে চলেছে অথচ এ ঘটনার পিছনে কারা কারা রয়েছে তার উদঘাটন করার দায়িত্ব সরকারের ও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা সহ আইনসৃংখলা রক্ষাকারী বহিনীরগুলোর আর ভিক্ষু সমাজ ও ইয়া বড় বড় বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দের। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিক্ষু সমাজ, বৌদ্ধ সমাজ সত্যি কি অসহায়, নাকি তারা চায়না এ হত্যাকান্ডের বিচার এ কারনে যে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু বৌদ্ধ সমাজের লুলা, ল্যাংড়া, অন্ধ নেতারা এবং ভিক্ষু সমাজ, বিচার কেন চাইবে ? ড. এফ দীপংকর মহাথেরতো তাঁদেও কেউ নন তাই বিচারতো তাঁর জন্মদাতিনী দরিদ্র মা পুঁটিরাণী বড়ুয়াই চাইবে, কেননা তাঁর গর্ভে দশ মাস দশ দিন ধারণ করে জন্ম দিয়েছিলেন বলে। এই দরিদ্র মা অভাব অনটনের সংসারে দীপংকর বড়ুয়াকে মরিচপোড়া দিয়ে ভাত খাইয়ে আজকের ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমাজের জন্য সন্তানকে আর্য্যপুরুষ হিসেবে দাঁড় হতে বলেছিলেন বলেই। তাই ৮০ বছর বয়সে মা পুঁটিরাণী বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজের আর্য্যপুরুষ ড. এফ দীপংকর মহাথের এর কফিনের পাশে বসে ঘুঁগড়িয়ে ঘুঁগড়িয়ে কাঁদে আর প্রশ্ন রেখে বলে আমি কি পাপ করেছি এই আর্য্যপুরুষকে জন্ম দিয়ে ? তবে ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমাজ সহায় হোক আর অসহায় হোক এই হত্যার বিচার করার, বিচার পাইয়ে দেওয়ার দায়িত্বতো রাষ্ট্রের, বিচার চাওয়া-পাওয়ার জন্য ভিক্ষুর দরিদ্র অসহায় পরিবার বা তাঁর জন্মদাতিনী মা’য়ের নয়। তারা শুধু এটাই ভাবছে যে কেউতো পাশে নেই এই জঘন্য অপরাধের বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য, তবে স্বপ্রনোদিত হাত বাড়াবে কি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ?
লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট-