খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় রাম্বুটান ফল চাষে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
॥ মোঃ আবুল হাসেম, মাটিরাঙ্গা ॥
পাহাড়ের পথ বেয়ে সড়কের পাশঘেঁষে এক কৃষকের বাড়ি। বাড়ির আঙিনায় গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির খুনসুটি। আর ঠিক পাশেই একটুকরো ঢালু জমিতে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে লাল-সবুজ রঙের বিদেশি ফল রাম্বুটান। পাহাড়ি মাটিতে এই অতি উচ্চমূল্যের ও মানসম্মত ফলের চাষ সাড়া ফেলেছে স্থানীয়ভাবে। কৌতূহলী মানুষজন প্রতিদিন ভিড় করছেন বাগান দেখতে। বলছি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার হাতিয়াপাড়া এলাকার সেই রাম্বুটান বাগানের কথা, যেখানে পাহাড়ের বুক চিরে জেগে উঠেছে সম্ভাবনার এক নতুন আলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাম্বুটান চাষ শুধু মাটিরাঙ্গা নয়, পুরো পার্বত্য অঞ্চলে কৃষির সম্ভাবনাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে পারে। ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর অফিসের তথ্যানুয়ায়ী মাটিরাঙ্গার হাতিয়া পাড়া, কাজি পাড়া, নতুন পাড়া, ১০নং, ব্যাঙমারা, সাপমারা, তপ্ত মাষ্টার পাড়া, বাইল্যাছড়ি, রাবার বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিজন কৃষককে ২০ টি করে ৩০ জন কৃষককে ৬০০ টি ভিয়েতনামী জাতের রাম্বুটানের চারা বিতরণ করা হয়। উচ্চমূল্যের ফল ফসলের জাত সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণ শীর্ষক ভ্যালু চেইন প্রকল্পের আওতায় (আরএমটিপি) পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহযোগিতায় ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর বাস্তবায়নের এবং মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসের সার্বক্ষণিক পরামর্শে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রুমা বেগমের নামে তার স্বামী রফিকুল ইসলাম কে ৩০ টি রাম্বুটানের চারা বিতরণ করা হয়।
মাত্র ৩ বছরের ব্যাবধানে কৃষক রফিকুল ইসলাম বিদেশি ফল রাম্বুটান চাষ করে চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছেন। আজ সেই বাগানেই ধরা দিয়েছে আশার আলো। বাগানের ১২টি গাছে ফল এসেছে। ফলগুলো অপরিপক্ক অবস্থায় সবুজ রং ধারণ করলেও পুষ্ট বা পাকলে লালচে রঙের হয়। আকর্ষণীয় ও স্বাদে অত্যন্ত মিষ্টি যা স্থানীয় বাজারে খুব সাড়া ফেলেছে। স্বাদে অনেকটা লিচুর বিকল্প হিসেবে খাওয়া যায়।
এদিকে, রফিকুল ইসলাম শুধু ফল বিক্রি করেই থেমে থাকেননি। তিনি নিজের বাগানের রাম্বুটান গাছ থেকে ২০০টি কলম করেছেন, যা তিনি প্রতিটি ১,২০০ টাকা দরে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছেন। এই উদ্যোগ একদিকে যেমন চাষ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবেও কাজ করছে। রফিকুল ইসলাম জানান, আইডিএফ কর্মকর্তারা একবার আমাদের এলাকায় আসেন। প্রথমে লেবুর চারা দেয়ার কথা ছিল। পরে তাদের দেখানো ভিডিওতে রাম্বুটান চাষ দেখে আগ্রহী হই এবং অনুরোধ করি রাম্বুটানের চারা দেয়ার জন্য। তারা আমাকে ৩০টি চারা দেন। গাছগুলো অনেক যত্নে লালন করতাম বলে অনেকে পাগলও বলতো। কিন্তু আমি দমে যাইনি। এখন প্রতি কেজি রাম্বুটান ১২০০ টাকা দরে বিক্রি করছি, ২০০টি কলম দিয়েছি। সর্বমোট ৩০/৪০ কেজি ফল বিক্রি করতে পারবো। আগামীতে সব গাছে ফল আসবে। আমি এখন সফল।
মাটিরাঙ্গা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ চাকমা বলেন, শুরু থেকেই আমরা কৃষক রফিকুল ইসলামকে পরামর্শ সেবা দিয়ে আসছি। রাম্বুটান চাষে ঝুঁকি কম, ফলন ভালো এবং বাজারে এর দামও অনেক বেশি। আশা করি, পাহাড়ে এই ফলের চাষ আরও জনপ্রিয় হবে। রাম্বুটান চাষ এখন শুধু সম্ভাবনার কথা নয়, বাস্তবতার উদাহরণ জানিয়ে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)-এর কৃষিবিদ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উচ্চমূল্যের ফল ফসলের জাত সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণ শীর্ষক ভ্যালু চেইন প্রকল্পের আওতায় আমরা রাম্বুটানের চারা বিতরণ করি। এই অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু রাম্বুটান চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রুমা বেগমকে আমরা ৩০টি রাম্বুটান গাছের চারা সরবরাহ করি। বর্তমানে তার বাগানে ভালো ফলন হয়েছে এবং তিনি বাজারে ভালো দাম পাচ্ছেন।
ফলন বাড়ানো ও কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এই প্রকল্পের আওতায় রাম্বুটানের পাশাপাশি এ্যাভোকাডো, খেজুর, সিডলেস লেবু, কপি, কাজুবাদাম, গৌরমতি আম ও ভ্যানিলা সহ বিভিন্ন উচ্চমূল্যের ফলের চারা বিতরণ করা হয়েছে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ সবুজ আলী জানান, “রফিকুল ইসলামের এই সফলতা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা তাকে শুরু থেকেই পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। তার সফলতা অন্য কৃষকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠছে। তাছাড়া বিদেশি ফল চাষে মাটিরাঙ্গার হাতিয়া পাড়ার কৃষক রফিকুল ইসলামের এই সাফল্য প্রমাণ করে, পরিকল্পিত উদ্যোগ এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে পাহাড়ি এলাকায়ও কৃষির নতুন দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব।