[vc_row][vc_column css=”.vc_custom_1596871563159{margin-bottom: 0px !important;}”][vc_column_text css=”.vc_custom_1596874329023{padding-top: -30px !important;}”]

শিরোনাম
দীঘিনালায় যৌথবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ কর্মী আটকবান্দরবানে রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবন জোড়পূর্বক দখলের অভিযোগবান্দরবানের থানচিতে ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশমানিকছড়িতে চাঁদাবাজি করতে এসে জনতার হাতে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকবরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগরাঙ্গামাটির লংগদুতে নৌকার কিছু নেতাকর্মী এখন ট্রাকে উঠে গেছেকাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টাসড়ক দুর্ঘটনায় কাপ্তাই বিএফআইডিসি এলপিসি শাখার কর্মচারী নিহতমানিকছড়ির নবাগত ইউএনও’র সাথে বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা বিনিময়খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
[/vc_column_text][/vc_column][/vc_row]

ক্ষুদ্র এসব জাতির নিজস্ব মাতৃভাষাগুলো বেঁচে থাক তবে প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ

যে ৬জন বেঁচে আছেন তারাও হারিয়ে গেলে মুছে যাবে খুমীদের ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা ও সংস্কৃতি

৭৮

॥ আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান ॥
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু ভাষাভাষি মানুষের দেশ। এখানে বৃহৎ জনগোষ্ঠী ইসলাম। বাংলাভাষা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় স্বীকৃত। আমাদের দেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ১৬টি জাতি গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতিও রয়েছে। তাঁদের এসব ভাষা সংস্কৃতির সংরক্ষণ বা পালনে বর্তমান সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা আন্তরিক বলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর ভাষার চর্চা এবং সংরক্ষণে এখন স্কুল পর্যায়েও তাঁদের জন্য আলাদা মাতৃভাষার বই দিচ্ছেন। সরকারও চায় ক্ষুদ্র এসব জাতির নিজস্ব মাতৃভাষাগুলো বেঁচে থাক তবে প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদি নিবাসী খুমীদের প্রকৃত ভাষাটির নাম ‘রেংমিটচ্য’। কালের ক্রমে অন্য বৃহৎ জাতিগোষ্টীর সাথে মিশতে গিয়ে হারাতে বসেছে এই ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা। তার কারণ হিসেবে জানা গেছে স্বল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠী হওয়াতে সামাজিক এবং পরিবেশগত কারনে অন্যের সাথে মিশে গিয়ে মুলত এই ভাষাটি একবোরে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। সচরাচর তাঁরা বাংলা ভাষাতে কথা বললেও তাঁদের নিজস্ব মাতৃভাষা হলো ‘রেংমিটচ্য ভাষা’। বর্তমানে আদি খুমী এ জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা একেবারে নেই বললেও চলে। সম্প্রতি এ জাতির মাত্র ৬য় জন বেঁচে আছেন। তবে অনেকের ধারনা অন্য ক্ষুদ্র জাতির সাথে মিশে যাওয়াতে তাঁদের ভাষাটিকে আরে ধরে রাখতে পারছেনা সেই সাথে বংশগতভাবেও জনসংখ্যার কমতে অথবা বিলুপ্ত হতে বসেছে।

খোঁজ নিযে জানতে পারা যায়, বর্তমানে এই “রেংমিটচ্য’ ভাষাটির জানা আছে মাত্র ৬ জনের। এ ভাষা জানা ছয়জনের মধ্যে একজন নারী ও পাঁচজন পুরুষ। ছয়জনের মধ্যে চারজনের বয়স ৬০ এর বেশি। এই জীবিতদের জানা আছে ভাষাটির তবে তাঁদের মৃত্যু হলে রেংমিটচ্য নামের ভাষাটির পৃথিবীর থেকে হারিয়ে যাবে সেই সাথে নিজস্ব সংকৃতিও। রেংমিটচ্য ভাষা জানা যারা ছয়জন আছেন তাঁরা সবাই দরিদ্র জুমচাষি এবং তাঁদের বসবাসের পাড়াগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম পাহাড়ে। তাঁরা রেংমিটচ্য ভাষা জানলেও তাঁদের একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ ও পরিবেশ নেই। এ জন্য ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ায় সবাই ম্রো ভাষায় কথা বলেন এবং নিজেদের ম্রো হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেংমিটচ্য ভাষা জানা ছয়জনের মধ্যে চারজন আলীকদম ও দুজন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম ম্রো জনগোষ্ঠীর পাড়ায় বসবাস করেন। আলীকদমের ৬৯ বছরের নারী কুনরাও, ৭৫ বছরের মাংপুন ও ৪৫ বছরের সিংরা ক্রাংসিপাড়ায় এবং ৫৮ বছরের থোয়াইংলক মেনসিংপাড়ায় থাকেন। ৭২ বছরের রেংপুন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবতপাড়ায় ও ৬০ বছরের মাংওয়াই একই উপজেলায় কাইংওয়াইপাড়ায় বসবাস করছেন। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে ১৭-১৮ কিলোমিটার দূরে তৈনখালের উপত্যকায় অবস্থিত। সেখান থেকে জুমচাষের জমির সন্ধানে পার্শ্ববর্তী এলাকায় রেংমিটচ্যরা সমগোত্রীয় ম্রোদের সঙ্গে মিলেমিশে আরও তিন-চারটি পাড়া গড়ে তোলেন। গত শতকের ’৫০ ও ’৬০ এর দশকে আলীকদমে চার-পাঁচটি পাড়ায় শতাধিক রেংমিটচ্যভাষী পরিবার ছিল। তাঁদের আদি বসবাসের স্থান ৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ক্রাংসিপাড়ায়। পাড়াটি থেকে তাঁরা সংখ্যায় বেশি একই সংস্কৃতির ম্রোদের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকেন এবং রেংমিটচ্য ভাষাও হারিয়ে যেতে থাকে।

রেংমিটচ্য ভাষা জানা কয়েকজন থাকলেও এই ভাষাভাষীর কোনো পরিবার নেই। এ কারণে ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা রেংমিটচ্য শেখার কোনো পরিবেশও নেই। তারা সবাই ম্রো ভাষা শিখছে ও কথা বলছে। জীবিত বয়স্কদের মৃত্যু হলে এ ভাষায় কথা বলার আর কেউ থাকবে না। ম্রো জনগোষ্ঠী নিয়ে ক্লাউস-ডিয়েটার ব্রাউনস ও লোরেন্স জি লোফলার ১৯৬০-এর দশকে ম্রো হিল পিপল অন দ্য বর্ডার অব বাংলাদেশ নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তাঁরা বলেছেন আরাকান থেকে আসা খামি নামে রেংমিটচ্য ভাষার একটি উপজাতি মাতামুহুরী উজানের ম্রোদের সঙ্গে মিশে গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ডারমুথ কলেজের লিংগুইস্টিকস অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন ২০১৩ সালে রেংমিটচ্য ভাষার ম্রোদের খুঁজে পেয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি বান্দরবান প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে রেংমিটচ্য ভাষার বিপন্নতার কথা তুলে ধরেন। রেংমিটচ্যভাষী থোয়াই লক ম্রো ও মাংপুং ম্রোর সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় পর দেখা হলে নিজেদের মধ্যে রেংমিটচ্য ভাষাতেই কথা বলতেন তারা। জীবিত ছয়জনের যে চারজন পুরুষ রয়েছে, তার মধ্যে মাংপুং ম্রোরা তিন ভাই। তবে তিনজনই তিন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছেন। গত বছর তিনজনের একসঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছিল সে রেংমিটচ্য ভাষাতেই। কিন্তু এখন কেউ কেউ অন্য কোথাও গিয়ে একেবারে ম্রো ভাষার মধ্যে মিশে গেছে। রেংমিটচ্য ভাষাটি আগামী প্রজন্মের সরক্ষণ করে রাখুক এটাই তাদের প্রত্যাশা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেছেন, কোনো ভাষার বিপন্নতা ও বিলুপ্তির অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বিভক্তি ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। বিভক্ত জনসংখ্যা অন্য জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যায় মিশে যায় এবং ভাষা হারিয়ে ফেলে। রেংমিটচ্য ভাষার বিপন্নতার জন্যও এটা প্রধান কারণ হতে পারে। ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি গ্রন্থের লেখক ও জেলা পরিষদের সদস্য সিংয়ং ম্রো বলেন, রেংমিটচ্য জানা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ২০১৩ সালে ৩৬ জনকে পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে (২০২২ সালে) সাবলীলভাবে বলতে পারা মানুষের সংখ্যা ছয়জনে নেমে এসেছে। জীবিত বয়স্কদের মৃত্যু হলে এ ভাষায় কথা বলার আর কেউ থাকবে না।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মোঃ শাফীউল মুজ নবীন জানিয়েছেন, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় সমতলে ও পাহাড়ে পাওয়া ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিপন্ন ভাষার মধ্যেও পার্বত্য চট্টগ্রামের রেংমিটচ্য ভাষা, সমতলের পাত্র জনগোষ্ঠীর লালেং ভাষা গুরুতর সংকটাপন্ন। সংকটাপন্ন লালেং ভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকার প্রধানের কাছে আবেদন এই ভাষাটি সংরক্ষনে উদ্যোগ নেয়া হোক।