“যে ঈদের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু”
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
অনেক দিন আগের কথা। ১৯৭৩ সালের এক অনন্য দিনের ইতিহাস। সে দিনটি অন্য সাধারণ দিনের মতো নয়। দিনটি ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দে-উল্লাসে মেটে উঠার দিন। ঈদ মানেই তো একমাস সিয়াম সাধনার পর মহা উল্লাসে-উৎসবে হারিয়ে যাবার দিন। সারা বিশ্বের মানুষের মতো সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলার মানুষ ও সেদিন হয়ত-আজকের উন্নয়নশীল এ দেশের মানুষের বর্নিল ঈদ আনন্দের মত না-হলেও কম-বেশী ঈদের আনন্দে বন্যায় ভেসেছিল। বাংলার দুঃখী মজুর মেহনতী মানুষের মহান বন্ধু, জাতির জনকের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীটি ও সেদিন গণমানুষের ঈদ উল্লাসে ছিল ভরপুর। সন্ধ্যার পর প্রয়াত প্রবীন খ্যাতিমান সাংবাদিক এবিএম মুসা ও সেদিন ছুটে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক এই বাড়ীটিতে, কালজয়ী কিংবদন্তীর এক মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেতে। অতঃপর সাংবাদিক এবিএম মুসাসহ আরো বেশ কিছু নেতা কর্মীর সাথে বাংলার দুঃখী মজুর মেহনতী মানুষের এ মহান বন্ধু, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষাৎ এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।
ঈদের দিন হলেও সেদিন বঙ্গবন্ধুর মনে আনন্দের ঢেউ ছিলনা, ছিলনা ঈদের খুশীর আমেজ। এ সময় সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও একজন মানুষের চোখ দুটি ফাঁকি দিতে পারেননি- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। যার চোখে বঙ্গবন্ধুর মনের বেদনার আগুন ধরা পড়ে যায়, তিনি প্রবীন সাংবাদিক এ.বি.এম মুসা। অতঃপর সাংবাদিক এ.বি.এম মুসা আর কাল বিলম্ব না-করে সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনার চোখ আর মূখই তো জাতির পিতার মনের দর্পন, ঈদের আনন্দঘন এ মুহুর্তে “বঙ্গবন্ধুর মনে বেদনার সুর” আমার কানে কি পৌঁছে না বলে ভাবছেন। সাংবাদিক এ.বি.এম মুসার প্রশ্নে বাঙালীর ভালোবাসার কাঙ্গাল, এ মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মূখে এক ঝলক কষ্টের হাসির দেখা মেলে। এ সময় সাংবাদিক এ.বি.এম মুসা সহ উপস্থিত সকলেই আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। তারপর হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুঃখ ভরাক্রান্ত মনে বললেন, আমি জানি আজ ঈদের দিন। এক মহা আনন্দ উৎসবের দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈদ জামাতে গিয়ে যখন দেখলাম, আমার দুঃখী মানুষগুলো ভিক্ষার থালা নিয়ে বলে, ও বাবা-একটা পয়সা ভিক্ষে দিন, তখন তো বঙ্গবন্ধুর মনে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে বেদনার আগুন জ্বলে উঠে, আমি পাগল হয়ে যায়। আমি স্বাধীনতা চেয়ে ছিলাম। তোমরা জান, আমার কথার মাঝে দুটি কথা ছিল। যদি অর্থনৈতিক মুক্তি না আসে তাহলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়। যদি আমার মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, যদি আমার মানুষ বেকার থেকে যায়, তাহলে আমার কিসের ঈদ-আনন্দ।
যে স্বপ্ন আমি তাদের (বাংলার মানুষকে) দেখিয়েছিলাম, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন ছাড়া বঙ্গবন্ধুর মনে কিসের ঈদের আনন্দ। স্বাধীনতার স্বাদ যেদিন ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারব, যেদিন বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠবে, যেদিন আমার স্বপ্ন পুরন হবে, সেদিন দেখবা, বঙ্গবন্ধুর ঈদ আনন্দের জোয়ার। আমার দূঃখী মানুষের মনে শান্তি না-আসলে আমার কিসের ঈদ। এদেশের দূঃখী মজুর মেহনতী মানুষকে বাল্যকাল থেকে অকৃত্রিমভাবে যিনি ভালোবেসে ছিলেন, তিনি একমাত্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেহ নয়। মাত্র ৬/৭ বছর বয়স থেকেই তিনি মানুষের কল্যাণমিত্র হয়ে দুঃখী মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর মতো হিমালয় সম-উদার হৃদয়ের মহামানব বাংলার ইতিহাসে খুবই বিরল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাল্যকালের ঘটনাগুলো মানবতার এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। শিশুকালে যিনি অন্যকে ছাতা দিয়ে নিজে বৃষ্টিতে ভিজতেন, অন্যকে গায়ের জমা খুলে দিয়ে নিজে গেঞ্জি পড়ে বাড়ী ফিরতেন, গায়ের চাদর, পাঠ্যপুস্তক, খাতা-কলম, টাকা-পয়সা, ধান-চালসহ যার যেটা প্রয়োজন ছিল, যিনি নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি দূঃখী মজুর মেহনতী মানুষের ভালোবাসার এক কাঙ্গাল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে মহামানবটি সারা জীবন বাংলার মেহনতী জনতার সার্বিক মুক্তি তথা রাজনৈতিক, সামজিক, অর্থনৈতিক ও বৈষ্যমের শৃঙ্খল মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। একটি সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে মাত্র সাড়ে তিন বছরে তাঁর বহু স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর স্বপ্ন গুলো পুরোপুরি পূরণ করে যেতে পারেননি।
১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট এক কালো রাতে আন্তর্জাতিক এবং এ দেশীয় ষড়যন্ত্রে সৃষ্টি হলো বিশ্ব ইতিহাসে এক ভয়ানক-ভয়াবহ কলংকময় অধ্যায়। বাংলা আর বাংলার মানুষকে অকৃত্রিম ভাবে ভালোবাসার অপরাধে, কালজয়ী কিংবদন্তীর মহানায়ক, দূঃখী মানুষের মহান বন্ধু, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবার-পরিজনকে দিতে হয় আত্মহুতি। যে মহাপুরুষ বাংলার দূঃখী মানুষের সার্বিক মুক্তি হলেই কিংবা তাঁর স্বপ্নগুলো পূরণ হলেই ঈদের মহা আনন্দে মেটে উঠার কথা বলেছিলেন। যার কারণে বঙ্গবন্ধু হয়তঃ ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্মদিনও পালন করেননি। মাঝেমধ্যে কেউ তাঁকে জন্মদিন পালনের কথা বললে, তিনি বলতেন- দূঃখী মানুষের সার্বিক মুক্তি না হলে, আমার জন্মদিনই বা কি আর মৃত্যু দিনই বা কি। বাঙালী জাতির এ মহান মুক্তির কান্ডারী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে বহু আগেই এ জাতির সার্বিক মুক্তি হতো, তাঁর স্বপ্নগুলো পূরণ হয়ে বাস্তবে রূপ নিত, আর এ দেশ সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিনত হত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাধীন চেতা মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর স্বপ্নগুলো বেঁচে আছে। যে ঈদের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবী। হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নই হউক- আজ বাংলার দূঃখী মজুর মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলী।
লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী