বান্দরবানে কলা গাছের আঁশ থেকে তৈরী এই প্রথম “কলাবতী শাড়ি”
॥ আকাশ মারমা মংসিং,বান্দরবান ॥
বান্দরবান জেলাকে বলা হয় অপরুপ সৌন্দর্য নৈসর্গিক পাহাড় কন্যা। এটি একটি পাহাড়ী জেলা হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর জেলা হিসেবেও বান্দরবান জনপ্রিয়। রয়েছে ইতিহাস ও ঐতির্হ্যরে কিছু নিদর্শনও। পাহাড়ী কোমর তাঁতের শাড়ী কাপড়তো রয়েছেই কিন্তু এবার যোগ হলো কলা গাছের তত্ত থেকে তৈরী ‘কলাবতী শাড়ি’। যার উদ্যোক্তা বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। যেটি প্রথম তৈরি হল বান্দরবানেই। তাছাড়া বাঁশ,কাঠ,সুতায় তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প নজর কারাতে ফুটিয়ে তুলছে প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রগুলো।
এ পর্যটন নগরীতে কলা গাছের আঁশের থেকে সুতা আর সেই সুতা থেকে তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় শাড়ি। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘কলাবতী সুতি শাড়ি’। এটিই সম্ভবত বাংলাদেশে কলাগাছের সুতায় তৈরি প্রথম শাড়ি। মৌলভীবাজার থেকে মণিপুরী কারিগর এর দীর্ঘ প্রচেষ্টা পর এই শাড়িটি তৈরি করেছেন তিনি। প্রথমবারের মত কলা গাছের সুতা থেকে শাড়ী তৈরীর উদ্যোগ নিয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। তার এই দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পর সাফল্যে অর্জনের ফলে বান্দরবান জেলাকে দেশের সামনে তুলে ধরেছেন। তার এই সাফল্যে অর্জনকে বান্দরবান জেলা সর্বস্তর মানুষ কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়ের বিভিন্ন জঙ্গলে রয়েছে শতশত কলা গাছ। শুরুতেই কলাগাছ কেটে চামড়া গুলো পানিতে ভিজিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেটিকে মেশিনে সাহায্যে বের করা হয় সুতা। সেটিকে দিনব্যপী রৌদ্রে শুকানো হয়। শুকানো পর কলাগাছ থেকে সুতা আর সেই সুতা থেকে তৈরী করা হয় ব্যাগ জুতা ফাইল, পাপোস, ফুলদানি কলমদানিসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প। পাশাপাশি সেই কলা গাছের সুতো থেকে দেশের এই প্রথম তৈরী হলো “কলাবতী সুতি শাড়ি”। তাছাড়া এই হস্তশিল্প তৈরী করতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে অনেক নারী। এই প্রশিক্ষণ মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে স্বপ্ন দেখছেন জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দেড়বছর আগে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি কলাগাছের তন্তু থেকে সুতা তৈরির একটি উদ্যোগ নেন। নারীর কর্মসংস্থান সেইসাথে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া এই লক্ষ্য থেকে প্রকল্পটিতে প্রথমদিকে বেসরকারি এনজিও সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন, গ্রাউস, উদ্দীপন ও লাফার্স সহায়তা দেয়। এছাড়া মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও উইমেন চেম্বার অব কমার্সও নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। বর্তমানে কালাঘাটার গুণমনি মনিপুরী ও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইং সাইং উ. নিনি দম্পতির বাসায় কলা গাছের সুতা দিয়ে শাড়ি ও নানা ধরনের হস্তশিল্প তৈরির কাজ চলছে।
প্রশিক্ষণ নিতে আসা হ্লাসিংমে, উম্মে আক্তার,থুই ম্রা মারমাসহ বেশ কয়েকজন বলেন, কলা গাছের সুতা তৈরি বুনন প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। এই প্রশিক্ষণের ফলে নারীদের আত্মকর্মসংস্থান তৈরী হবে। এই কলা গাছে সুতা তৈরী বিভিন্ন হস্তশিল্প গুলো দেশের বাহিরে চাহিদা থাকবে। আর পর্যটন নগরী হিসেবে এটি আমরা অনলাইন ও বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারবো।
মৌলভীবাজারে ১৯৯২ সাল থেকে মণিপুরি শাড়ি তৈরী করচ্ছেন কারিগর রাধাবতী দেবী। এ পর্যন্ত তিনি কত শাড়ি বানিয়েছেন, তার হিসাব নেই। তবে এবার তিনি বুনেছেন কলাগাছের সুতার শাড়ি।
মণিপুরী শাড়ি কারিগর রাধাবতী দেবী বলেন, জীবনে অনেক রকমের শাড়ি তৈরি করেছি। কিন্তু কলা গাছের আঁশের সুতায় প্রথম শাড়ি তৈরি করলাম। বান্দরবান এসেছিলাম শাড়ি তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়ে।পরীক্ষামূলক ভাবে ১৫ দিনের চেষ্টায় একটি শাড়ি তৈরি করতে পেরেছি। একটা সময় মনে হয়েছিল সম্ভব নয়, কিন্তু শেষপর্যন্ত সফলভাবে শাড়ি তৈরি করতে পেরে আমি ভীষণ খুশি।
তিনি বলেন, প্রথমদিকে আঁশ থেকে সুতা তৈরি করা, সুতাগুলো প্রক্রিয়া করাসহ জিনিসপত্র গোছাতেই ৮ দিন লেগে যায়। শাড়ির কাপড় বুনতে সময় লেগেছে ৭ দিন। একটা শাড়ি বুনতে পাঁচশ গ্রাম সুতা লাগলেও কলাগাছের আঁশের সুতায় প্রথম শাড়িটি বুনতে এক কেজির মতো সুতা লেগেছে।আগামীতে সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক থাকলে একদিনেই মেশিনে একসঙ্গে তিনটি শাড়ি তৈরি করা যাবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগী বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইং সাইং উ বলেন, পাহাড়ের নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি ও দারিদ্র্য নিরসনে কলাগাছের আঁশ থেকে সুতা তৈরি এবং কলাগাছের সুতায় ব্যাগ, ঝুড়ি, ফুলদানি, কলমদানি, ফাইল ফোল্ডার, পাপসসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র তৈরির কাজ শুরু করি। পাহাড়ের নারীদের এ কাজে প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। কলাগাছের সুতায় শাড়ি তৈরি এ প্রকল্পের বড় সফলতা। পরীক্ষামূলকভাবে সফলতা পাওয়ায় টেকসই এবং গুণগতমান ঠিক রেখে শিল্পটি সম্প্রসারণ করা গেলে এ অঞ্চলে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তীবরীজি বলেন, স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে কলাগাছের আঁশের সুতায় বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। দেখতে সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব এসব জিনিস তৈরিতে পাহাড়ের চারশ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতা প্রতি কেজি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তৈরি করা জিনিসপত্রগুলোও ‘ব্র্যান্ডিং বান্দরবান’-এর মাধ্যমে নীলাচল পর্যটন স্পটসহ স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে পর্যটকদের মাঝে বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে মানসম্মত পণ্য তৈরি, টেকসই শিল্প হিসাবে গড়ে তুলতে উন্নতমানের মেশিনসহ কারিগরি সহায়তায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে।