[vc_row][vc_column css=”.vc_custom_1596871563159{margin-bottom: 0px !important;}”][vc_column_text css=”.vc_custom_1596874329023{padding-top: -30px !important;}”]

শিরোনাম
দীঘিনালায় যৌথবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ কর্মী আটকবান্দরবানে রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবন জোড়পূর্বক দখলের অভিযোগবান্দরবানের থানচিতে ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশমানিকছড়িতে চাঁদাবাজি করতে এসে জনতার হাতে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকবরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগরাঙ্গামাটির লংগদুতে নৌকার কিছু নেতাকর্মী এখন ট্রাকে উঠে গেছেকাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টাসড়ক দুর্ঘটনায় কাপ্তাই বিএফআইডিসি এলপিসি শাখার কর্মচারী নিহতমানিকছড়ির নবাগত ইউএনও’র সাথে বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা বিনিময়খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
[/vc_column_text][/vc_column][/vc_row]

“মুক্তিযুদ্ধে অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম- (০৫)”

১১৬

॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥

১৯৪৭ সালে ভারত বর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং বাঙালীর উপর অমানবিক শোষন নির্যাতন চালাতে থাকে। অতঃপর হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতির ভালোবাসার কাঙ্গাল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলার মানুষ পর্যায়ক্রমে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যায়। বাঙালী জাতির মুক্তির চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে অনেক দুরভিসন্ধি থাকা স্বত্ত্বেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বৃহত্তর পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিনত হয়। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর না-করে আবারও ষড়যন্ত্রের পথে হাটতে থাকে। এক পর্যায়ে এ বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরিমধ্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বাধীন চেতা এই মহান-মহানায়কের ০৭ মার্চের মহাকাব্যের বজ্রকন্ঠের আহ্বানের প্রতিধ্বনী বাংলার ঘরে-ঘরে, সবুজ প্রান্তরে প্রতিধ্বনীত হতে থাকে। সে সময় বাঙালী জাতির হাজার বছরের এ সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে এবং নির্দেশে ১৯৭১ এর ০১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) আন্দোলন চলতে থাকে। অতঃপর ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালোরাতে বর্বর পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নিরস্ত্র, ঘুমন্ত অসহায় মানুষের উপর নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে আক্রমন চালাতে থাকে। এমন ভয়ানক এক কঠিন সময়ে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই বাঙালী জাতির এ সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে সেই রাতেই স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। তারপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষনার পর পাকিস্তানীদের পোষা কুকুর আর পা চাটা ভৃত্যরা ছাড়া এ বাংলার দুঃখী মজুর মেহনতী মানুষ, ছাত্র-যুবক, সামরিক-বেসামরিক সর্বস্থরের মানুষই কোন না কোনভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল।

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাতে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী “অপারেশন সার্চ লাইট” এর নামে বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলে অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের তথা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, রামগড়সহ বেশ কিছু এলাকায় ডিফেন্স লাইনে খাদ্য দ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সংগ্রহ করে পাঠানোর কাজে পাহাড়ের ছাত্র-যুবকেরা স্বত্বঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। এ ভয়াবহ-ভয়ানক কঠিন এক অগ্নিঝরা দুঃসময়ে, পাহাড়ের এক অকুতোভয় অগ্নি সন্তান, যিনি জীবন-মরণপন করে স্ব-পরিবারে এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি আমাদের খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী। তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সহ পার্বত্য এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে এবং নানাভাবে সহযোগীতা প্রদান করে মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জল ভূমিকা রেখেছিলেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবী সরকারের হাতে প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা তুলে দেওয়ার কৃতিত্ব যিনি অর্জন করেছিলেন, তিনি আর কেহ নয়, তিনি আমাদেরই মানিকছড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী। সে ভয়ানক কঠিন দুঃসময়ে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এক মৃত্যুপুরীতে পরিনত হয়। চারদিকে লাশ আর লাশ, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাতে থাকে বর্বর পাকবাহিনী। হত্যা ধর্ষন লুটপাত আর ধ্বংস যেন তাঁেদর নেশায় পরিনত হল। অসহায় মানুষের মৃতদেহগুলো কাক-শেয়াল আর কুকুরের খাবারে পরিনত হল। সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল শকুন তাড়িত এক শ্মশান ভূমি। তখন শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচার আকুতি নিয়ে এ দেশের অসহায় অসংখ্য মানুষ ভারতে চলে যেতে থাকে। সে অগ্নিঝরা দুঃসময়ে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ ও রামগড় হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম মহকুমায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। তখন ভারতে যাওয়ার পথে মানিকছড়ির এ মং রাজা বীর মুক্তিযোদ্ধা মংপ্রু সাইন চৌধুরীই ছিল অসহায় মানুষের একমাত্র শেষ ভরসা, নিরাপদ আশ্রয় দাতা।

রাজবাড়ীতে এসে কোন মানুষ যেন উপোস না-থাকে তার জন্য খাবারের বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল। শত ব্যস্ততার পরও পাহাড়ের এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা আগত মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে চেষ্টা করতেন। তাঁরা খাবার খেয়েছে কিনা কিংবা তাঁদের কোন সমস্যা আছে কিনা এসব বিষয়েও নজর রাখতেন- পাহাড়ের এ মহান মানুষটি। মানিকছড়ির রাজবাড়ী ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে পথের ধারে জনবল নিয়োগ করে অসহায় মানুষের জন্য খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের এ অগ্নিঝরা কঠিন সময়ের মধ্যে রাজবাড়ীর হলরুমে সু-চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছিলেন মানবদরদী এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী। রাজবাড়ীর হলরুমটি সেদিন যেন হাসপাতালে পরিনত হয়েছিল। পাহাড়ের এ বীর সেনানী মং রাজার স্ত্রী রাণী নিহার দেবী সে সময় রানীর বেশ ছেড়ে একজন নার্স কিংবা ধাত্রীর বেশে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন। সে দুঃসময়ে রানীর পদাংক অনুসরন করে সে সময় পাহাড়ের বহু মা-বোন ও মানবতার সেবাই এগিয়ে এসেছিল। সেই ভয়াবহ ভয়ানক দুঃসময়ে অসংখ্য অসহায় মা-বোনদের গর্ভপাতের মতো কঠিন কাজও সহজভাবে সম্পন্ন করেছিলেন পাহাড়ের এই মানবতা জয়ী মা-রাণী নিহার দেবী। এ মহান রাণী মায়ের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী এবং তার পরিবারের গৌরবোজ্জল সংগ্রামী অধ্যায় চিরভাস্কর হয়ে থাকবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজার হাজার অসহায় মানুষের আশ্রয়, খাবার এবং সুচিকিৎসার পাশাপাশি পাহাড়ের এ অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা খাগড়াছড়িকে শত্রুমুক্ত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি মানিকছড়ি এবং রামগড় প্রতিরক্ষার কাজে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি গাড়ী এবং অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র প্রদান করেন।

অতঃপর ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল বর্বর পাকসেনারা যখন রামগড় দখলে নেয়ার জন্য তিন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে, যখন মানিকছড়ি, রামগড়ের পতন অতি সন্নিকটে, তখন আমাদের পাহাড়ের এ অকুতোভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা মং রাজা স্ব-পরিবারে ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরদিন ১৯৭১ এর ০১ মে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রথমে ভারতের সাব্রুম এবং পরে হরিণা ক্যাম্প সংলগ্ন রূপাইছড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। রুপাইছড়িতে ছিল বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্য এক বিশাল আশ্রয় কেন্দ্র। সেখানে তিনিও স্ব-পরিবারে আশ্রয় নিলেন। অতঃপর সেখানে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন পাহাড়ের এ অদম্য বীরসেনা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী। সেখানে থেকে তিনি হরিণা ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রেখে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের রিক্রুটিং, প্রশিক্ষণদানসহ বাংলদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা অপারেশন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পাহাড়ের এ বীরসেনা মং রাজা খুব দক্ষতার সাথে আগ্নেয়াস্ত্রও চালাতে জানতেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে মিত্র বাহিনীর সাথে থেকে সম্মুখ যুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর সাহসিকতার জন্য সে সময় মিত্র বাহিনীর সদস্যরা আমাদের এই বীর সন্তানকে অনারারী কর্নেল র‌্যাঙ্ক প্রদান করে। আখাউড়া, আশুগঞ্জ ও ভৈরব অপারেশনে অসাধারণ দক্ষতার প্রমান দেখিয়ে ছিলেন পাহাড়ের অহংকার এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী।

মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ অদম্য বীর পুরুষকে বর্বর পাক সেনারা অপহরনের চেষ্ঠার ত্রুটি করেনি। অবশেষে তাঁরা ব্যর্থ হয়ে মানিকছড়ির রাজবাড়ীতে তাঁদের আঞ্চলিক সদর দপ্তর স্থাপন করে। তারপর রাজাকার আর বর্বর পাকসেনারা মিলেমিশে আমাদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ীটির সমস্ত ধন-সম্পদ লুটে নিয়ে যায়। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে পাহাড়ের যে মহান মানুষটি স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে স্ব-পরিবারে অনেক অনেক মূল্য দিয়েছেন। তিনি এখন পৃথিবীতে নেই। জীবিত থাকাকালীন এ বীর পুরুষকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এ প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হউক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। যার নেতৃত্বে বাঙালী জাতির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন-মহান স্বাধীনতা, সেই মহান স্বাধীনতা এবং স্বাধীন বাংলার স্থপতি, বাংলার হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরীসহ সকল বীর শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরঙ্গনাদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)

কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।