“মুক্তিযুদ্ধে অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম-(০৪)”
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
এক সময় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ বড়ই দুঃখিনী, আর বাঙালী জাতি ছিল-বড্ড আভাগা। হাজার বছর ধরে এ দুঃখিনী বাংলা আর অভাগা বাঙালীরা বিদেশী হায়েনার আক্রমনে বারবার আক্রান্ত হয়েছে। কালের পর কাল বাংলা আর বাঙালীরা বঞ্চিত, লাঞ্চিত এবং নির্যাতিত হয়েছে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা থেকে শুরু করে তীতুমীর, প্রীতিলতা, মাষ্টার দা সূর্যসেন, হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং ক্ষুদিরামের রক্তধারা প্রবাহিত হয়ে, হাজার বছরের সর্বশেষ্ট বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তেভেজা, প্রায় তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাঙালী জাতির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন, মহান স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে কিছু সংখ্যক মীর জাফর আর অমানুষ ছাড়া সারা দেশের মত পাহাড়ের সূর্য সন্তানরা ও জীবন মরণপন করে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এ অঞ্চলের সংগ্রামী ইতিহাস ছিল- সত্যিই গৌরবোজ্জল। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র হাতে যারা সরাসরি যুদ্ধ করে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করে অনন্য এক গৌরব গাঁথা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ১নং সেক্টরের সাবেক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা অন্যতম। তিনি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার তথ্য অফিসার হিসাবেও সততা এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সে অকুতোভয় বীর সেনানীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালী জাতির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আর ঘরে বসে থাকেননি। তৎকালীন অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় মহকুমার ছাত্র-যুবকদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালোরাতে দখলদার হিংস্র-বর্বর পাকবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বহু স্থানে নিরস্ত্র, অসহায়, ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তাঁরা।
যখন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পাকসেনারা ট্যাংক চালিয়ে ও মেশিনগানের গুলি বর্ষন করে, নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল, তখন পাহাড়ের এ অদম্য বীর, মহান স্বাধীনতার বাঁচা-মরার এই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকবাহিনী তৎকালীন বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর দখলে নেয়ার পর-পরই বান্দরবান মহকুমাও দখল করে নেন। অতঃপর ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি দখল করে তাঁরা। ১৯৭১ সালের ০২ মে বিকেল ৪.০০ ঘটিকায় রামগড় মহকুমা হেডকোয়ার্টার ও পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে সেদিন রামগড় পুলিশ ষ্টেশন, রামগড় হাসপাতাল, রামগড় বাজার এবং সীমান্ত এলাকায় ব্যাপকভাবে ক্ষয়-ক্ষতি হয়। রামগড় দখলে নেয়ার পর বর্বর পাকসেনারা জগন্যতম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। রামগড় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি কাজী রুহুল আমিনের বড় ভাই কাজী আব্দুল লতিফকে তাঁরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিষ্ঠুর অমানবিক নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমরা এ অকুতোভয় বীর শহীদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাত দান করুন-এই দোয়াই করি। বর্বর পাকবাহিনী সেদিন রামগড় মহামুনি বৌদ্ধ বিহারের বৌদ্ধ মুর্তিটিও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে ও রাইফেল দিয়ে গুলি বর্ষন করে ক্ষত-বিক্ষত করে এবং বৌদ্ধ মুর্তিটির ডান হাতটিও কেটে ফেলে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহে তাঁদের ঘাঁটি স্থাপন করার পর, বিভিন্ন এলাকায় শান্তি কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী ও হিল রাজবাহিনী গঠন করে বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার ও বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে।
রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ পাকবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে উপজাতিয় নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিকভাবে শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষন করার পর উলংগ অবস্থায় বন্ধী করে রাখত। শুধু তাই নয়-এ বর্বর পাকসেনারা রামগড় উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প হতে উপজাতীয় নারীদের ফেনী নদীতে উলংগ অবস্থায় গোসল করতে নিয়ে যেত। এ ভয়াবহ, নিষ্ঠুর অমানবিক দৃশ্য শুধু এখানকার মানুষেরা নয়, সীমান্তের ওপারের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম এর মানুষেরাও প্রত্যক্ষ করেছে। পরে ওপারের সাব্রুম এর বাসিন্দারা চিৎকার করে এর প্রতিবাদ জানালে আমাদের মা-বোনদের নদীতে নামানো বন্ধ করে বর্বরপাকবাহিনী। রামগড় পতনের পর এক ভয়ানক পরিস্থিতিতে পঁচিশ জনের একটি বীর সেনানীর গ্রুপ নিয়ে ভারতের হরিনা ক্যাম্পে গিয়ে উপস্থিতি হন-পাহাড়ের এ অগ্নিতরুন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। সেখানে কর্তৃপক্ষ রামগড় মহকুমার ছাত্র-যুবকদের একত্রিত করে ৪০ জনের একটি টিম গঠন করে এবং এ টিমের কমান্ডার হিসাবে এ অকুতোভয় বীরসেনাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। অতঃপর হরিনা ক্যাম্প থেকে পাহাড়ের এ কমান্ডারের নেতৃত্বে তাঁর গ্রুপটিকে প্রশিক্ষনের জন্য ভারতের অম্পি নগরে প্রেরণ করা হয়। চারপাশে সবুজ আর পাহাড়, অরন্যবৃত অম্পি নগর ট্রেনিং ক্যাম্পে গেরিলা আক্রমনের কলা-কৌশল, রাইফেল, এস.এল.আর, এস.এম.জি, এল.এম.জি চালানোসহ হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং কমান্ডো ট্রেনিং অত্যান্ত দক্ষতার সাথে ০২ মাসের মধ্যে শেষ করলেন তাঁরা। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭১ এর জুলাই মাসে আবারো হরিনা ক্যাম্পে তাঁদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তৎকালীন রামগড় মহকুমা বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলার সকল প্রশিক্ষন প্রাপ্ত মুক্তিসেনাদের একত্রিত করে, বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করে, একটি কোম্পানী গঠন করা হয়। যে কোম্পানীর অধিনায়ক এর দায়িত্ব পান আমাদেরই পাহাড়েরএ সূর্য সন্তান হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যান্তরে গেরিলা অপারেশন এবং বর্বর পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমনের নির্দেশনা দেয়া হয় তাঁকে। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে গেরিলা আক্রমন এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কমান্ডার এর দায়িত্বও পান তিনি। শুধু তাই নয়- গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বৈষ্ণবপুর এবং বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা রামগড় মহকুমা হয়ে চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য অঞ্চলে নিরাপদে প্রেরণের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের ০৫ জুলাই পাহাড়ের এ অকুতোভয়অগ্নি সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, রামগড় নাকাপা এলাকায় তাঁর দলবল নিয়ে প্রথম গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন এবং এ অপারেশনে বর্বর পাকবাহিনীর একজন সহযোগীকে আটক পূর্বক বিচারের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তরও করেন। পাহাড়ের এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা’র প্রথম অপারেশনে বাংলাদেশ এফ.এফ ফোর্স গ্রুপ নং- ৯১ এর ১৬ জন সদস্য সহ রঞ্জিত দেব বর্মন, ধমনি কান্তি বড়ুয়া, সমরকৃষ্ণ চক্রবর্তী, ভুবন ত্রিপুরা, নীলা মোহন ত্রিপুরাসহ আরো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। রামগড় মহকুমাতে ছিল পাকবাহিনীর হেডকোয়াটার এবং অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে পাকবাহিনীকে ভীত সন্ত্রস্ত করতে পাহাড়ের এ অদম্য কমান্ডারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন রামগড়ে পাকবাহিনীর হেডকোয়াটারে আক্রমন করেন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে সেই রাতের ১২.০০ ঘটিকা থেকে দলবল নিয়ে ০১.০০ ঘন্টা যাবৎ অবিরাম গুলি বর্ষন করে বর্বর পাকসেনাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে ছিলেন তাঁরা। এ অপারেশনে পাহাড়ের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সাথে রণ বিক্রম ত্রিপুরা, রঞ্জিত দেববর্মন, ধমনি কান্তি বড়ুয়া, সমর চক্রবর্তী, ভুবন ত্রিপুরা, নীলা মোহন ত্রিপুরা সহ আরো অসংখ্য মুক্তিসেনারা অংশগ্রহণ করে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানার ডাইনছড়ি চেম্প্র পাড়া এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এক দুধর্ষ গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন তিনি। ডাইনছড়ির গহীন অরন্যে মুক্তিসেনাদের গোপন ক্যাম্পে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সেদিন অবস্থান করেছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। দুপুর বেলায় হঠাৎ এক ইনফরমার এসে তাঁকে বললেন, বাটনাতলী এলাকায় উপজাতীয় পল্লীতে পাকবাহিনী প্রবেশ করেছে। সেখানে দুপুরের খাবারের আয়োজনও চলছে। বাটনাছড়ি আর ডাইনছড়ি খুব কাছাকাছি এলাকা।
আমাদের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আর কাল বিলম্ব না-করে গেরিলা হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন এবং ১২ জন দুর্ধষ গেরিলা বাছাই করে নিলেন। অতঃপর গোপন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ডাইনছড়ি চেম্প্র পাড়া এলাকার একটি বড় টিলার উপর দলবল নিয়ে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর ১০ জন বীর মুক্তিসেনাকে পজিশনে রেখে ০২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনীর অবস্থান রেকি করার কাজে বেরিয়ে পড়লেন-পাহাড়ের অপরাজিত এ অধিনায়ক। দুপুরের আহার শেষে এবার পাকসেনারা নিজ গন্তব্যে ফিরে যেতে রওয়ানা হলেন। আমাদের অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের রেকি করাও শেষ হল। যে টিলার উপর ১০ জন বীর মুক্তিসেনা পজিশনে আছেন, সে টিলার পাশে জংলী পথ ধরেই বর্বর পাকসেনারা যাবেন। পাহাড়ের এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আর কাল বিলম্ব না করে ০২ সহ-বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রলিং করতে করতে সাথী যোদ্ধারা যে টিলার উপর পজিশনে আছেন, সে টিলারই পদদেশে এসে দুটি গাছের আড়ালে অবস্থান নিলেন। টিলার উপর উঠার সুযোগ আর তাদের ছিলনা। বর্বর পাকসেনারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান একটুও বুঝতে পারেনি। অবশেষে পাকসেনারা যখন টিলার পাশের জংলী পথ ধরে যাচ্ছেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতি সন্নিকটে এসে পড়লেন, ঠিক তখনই আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের অটোমেটিক এস.এম.জি এবং সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এল.এম.জি গুলোও একসাথে গর্জে উঠে। পাকবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন একটি ঘোড়ার উপর চড়া অবস্থায় ছিলেন। প্রথম ব্রাশ ফায়ারের সাথে সাথে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে আহাজারী করতে লাগলেন। অনবরত গুলি বর্ষনের মুখে এ গেরিলা আক্রমনে ১২ জন পাকসেনার মৃত্যু হয়। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এমুনিশান শেষ হবার পূর্বেই কোন হতাহত ছাড়াই সাথী বীর যোদ্ধাদের নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করেন পাহাড়ের এ অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা।
অতঃপর বর্বর পাকবাহিনী রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে সংলগ্ন মারমা গ্রামটি সেদিন আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এছাড়া আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের এ অদম্য অগ্নি তরুন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠা বীরসেনারা নাকাপা পাতাছড়া পাকবাহিনী ক্যাম্প আক্রমন, যোগ্যছলা অপারেশন, রামগড় মহামুনি পাড়া অপারেশন, গুইমারা অপারেশসহ অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করেছিলেন। পাহাড়ের এ সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং তাঁর অদম্য বীরমুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি পার্বত্য অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর চলাচলের সুবিধার্থে খাগড়াছড়ির নাকাপা, কুমারীপাড়া, মানিকছড়ি, পাগলাপাড়া, যোগ্যছলা, ডাইনছড়ি ও গাড়ীটানা এলাকার গহীন অরন্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প এবং আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব ক্যাম্পগুলোতে স্থানীয় হেডম্যান, কার্বারীসহ পাহাড়ী-বাঙালী সর্বস্থরের মানুষই খাদ্যশস্য সরবারহ সহ পাকবাহিনীর গতিবিধি ও তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপুর্ণ সহযোগীতা করত। এ অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠা গ্রুপটি অস্ত্র হাতে যেমন যুদ্ধ করেছে, তেমনী হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সহযোগীতাও করেছে। ভারতে যাওয়া এবং আসার পথে হাজার হাজার গেরিলাদের আশ্রয়স্থল ঠিক করে দেয়া, জংলী পথে পথ দেখানোসহ আশ্রয়স্থল পাহারা দেয়ার দায়িত্বও পালন করেছিল তাঁরা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রমের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল রামগড়। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর দীর্ঘ সাত মাস ছয় দিন পর বর্বর পাক সেনাদের পরাজিত করে সেদিন আমাদের সূর্য সন্তানরা রামগড়ে উড়িয়েছিল স্বাধীন বাংলার রক্তেভেজা সবুজের বুকে লাল বিজয় নিশান। ০১নং সেক্টরের অবিভক্ত বৃহত্তর জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা এবং তাঁর গ্রুপের অকুতোভয় বীর সেনাদের গৌরবোজ্জল ইতিহাস চির ভাস্কর হয়ে থাকবে। এ বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে, যে মহামানবের নেতৃত্বে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্ম প্রকাশ করেছে, সে স্বাধীনতার এবং স্বাধীন বাংলার স্থপতি, বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরঙ্গনাসহ ত্রিশ লক্ষ বীর শহীদদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।