আমার দুঃখিনী প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ এখন ভালো নেই, বড্ড অসহায়
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
যে সময় পর্যটন কমপ্লেক্স সহ রাঙ্গামাটিতে বর্তমান সময়ের মতো তেমন একটা পর্যটন শিল্পের বিকাশ হয়নি, সে সময় দেশ-বিদেশের পর্যটকসহ শহরের মানুষগুলোর মন ভালো করার যে কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানটির নাম- রাঙ্গামাটি বালুখালী হর্টিকালচার সেন্টার। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে রাঙ্গামাটিতে ইদানিং অসংখ্য পর্যটন স্পট গড়ে উঠলেও কিন্তু বালুখালী হর্টিকালচার সেন্টার এর আকর্ষণ অদ্যাবধি একটুও কমেনী। আমাদের শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত সেই চির সবুজ মায়াবী স্থানটি এখন ক্ষত-বিক্ষত। এখানকার মানুষের সুখে-আনন্দে জড়িয়ে থাকা প্রিয় গন্তব্যটির দু’চোখ জুড়ে এখন নিরবে নিবৃত্তে বেদনার অশ্রু ঝড়ছে। চলমান ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ম সপ্তাহে বালুখালী হর্টিকালচার সেন্টারে এক নির্মম ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। আমার-আপনার হারানো দিনের বহু আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলোর নিরব স্বাক্ষী বয়সী ছায়া বৃক্ষগুলো এখন আর ছায়া দেবে না, বিলাবে না অক্সিজেন নামক মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। সেখানকার বয়সী বৃক্ষগুলো দেদারছে কেটে সাবাড় করা হয়েছে। বহু পুরোনো ছায়াবৃক্ষগুলো স্তুপ করে রাখা হয়। জীবন্ত সেই বৃক্ষগুলো এখন নিরব-নিথর প্রাণহীন হয়ে লাশের মতো পড়ে আছে। ওরা আর কোনদিন মানুষের ত্যাগকরা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাসাইড গ্রহণ করবে না। বৃক্ষ আছে বলে মানুষসহ প্রাণীকুল বেঁচে আছে। এ বৃক্ষই আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। মহামারী করোনা কালীন সময়ে মানুষ মর্মে মর্মে বুঝেছে, অক্সিজেন যে কতো মহামূল্যবান দ্রব্য। অথচ এখন পৃথিবীতে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যায়।
মাঝে-মধ্যে এ মহামূল্যবান দ্রব্যটি কোটি টাকার বিনিময়ে ও পাওয়া যায় না। অথচ যে বৃক্ষরাজি বিনাস্বার্থে-বিনামূল্যে মানুষকে অক্সিজেন বিলিয়ে যাচ্ছে, আর মানুষের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাসাইড গ্রহণ করে মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে মানুষই এখন একক স্বার্থে প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধনে মগ্ন হয়েছে এবং বনজ সম্পদ উজাড় করে চলেছে। বালুখালী হর্টিকালচার সেন্টার এর বৃক্ষরাজির প্রাণ কোন সাধারণ মানুষ হরণ করেনি। অমানবিকভাবে এ বৃক্ষগুলোর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বৃক্ষ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান-কৃষি বিভাগ। আমরা কার উপর আস্তা রাখব? কে আমাদের আশার আলো দেখাবে? এখন রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় নিরবে নির্ভৃতে, প্রকাশ্যে-অ-প্রকাশ্যে চলছে প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ বিধ্বংসী মহোৎসব। বান্দরবান সদরের টংকাবতি ইউনিয়নের শফিকুর রহমান পাড়া এলাকার একজন বাসিন্দা- -সামশু মিয়া। তিনি সেখানে নিজ জমিতে একটি মৎস্য খামার গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। যেমনী পরিকল্পনা-তেমনী তার বাস্তবায়ন। অতঃপর চলমান ২০২৩ সালের জানুয়ারী মাসের মাঝমাঝি সময় থেকে পাহাড় কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেন তিনি। এরই মধ্যে টংকাবতি ইউনিয়নের শফিকুর রহমান পাড়া এলাকায় তার মৎস্য খামারের পুকুরের জন্য, রাস্তার জন্য তিনটি পাহাড় ও হাঙ্গঁর খালের পাড় কেটে ফেলেছেন। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড় কেটে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ এবং পুকুর ও খনন করে ফেলেছেন। টংকাবতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো বললেন, জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে পাহাড় কাটা শুরু হয়। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও টংকাবতি পুলিশ ক্যাম্পকে জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ সুযোগে নির্বিঘ্নে পাহাড় কেটে ধ্বংস করে ফেলেছে।
একজন সামশু মিয়া হীনস্বার্থে ভয়াবহ ভাবে পাহাড় ধ্বংস করে এক লাখ ঘনফুট মাটি কাটায় প্রাণ-প্রকৃতি সহ পরিবেশের হুমকি তৈরী করেছে। অবশেষে সামশু মিয়ার পাহাড় কাটার কাজ যখন শেষ হলো, অতঃপর “ডাক্তার আসবার পূর্বে রোগী মারা যাবার মতো” ১৪ ফেব্রুয়ারী/২০২৩ইং তারিখে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরা পাহাড় কাটার প্রমাণ পেলেন। সামশু মিয়ার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়। দীর্ঘ একটি মাস যাবৎ এক্সকাভেটর (খনন যন্ত্র) দিয়ে সামশু মিয়া-তিনটি পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলেছে, হাঙ্গঁর খালের পাড় কেটে ফেলেছে, প্রশাসনের কোন হস্তক্ষেপেই ছিল না। এভাবে আর কতদিন চলবে, কে জানে ? তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়টি ঠিক নয় বলে দাবী করেছেন, বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউ.এন.ও) সাজিয়া আফরোজ। তিনি বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় প্রশাসনের জানা-অজানার মধ্যে প্রতিনিয়ত এ সব অপকর্মগুলো দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ ব্রিক ফিল্ডে পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে ইট তৈরী হয়। ইট ভাটায় পাহাড়ের বন উজার করে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে- ইটের ভাটায় এখন ব্যাপকভাবে খেঁজুর গাছ ও জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এ গাছের সংখ্যা এখন দিন-দিন কমে যাচ্ছে। খেঁজুর গাছের মূল্যে কম হওয়ায় এটি বেশী পোড়ানো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে “ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩” কেউ সঠিকভাবে মানছে বলে মনে হচ্ছে না। আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই বলে এখন প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ খেকোর দল দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এখানে প্রভাবশালী মহল ক্ষমতার খুঁটির জোরে বেপরোয়া হয়ে একক স্বার্থে পাহাড় কাটে, নদ-নদী, হ্রদ দখল-দূষণে লিপ্ত থাকে, বনভূমিও উজার করে। আবার তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্শিবাদে এসব অপকর্মে সাধারণ মানুষও লিপ্ত রয়েছে। বিগত এক দশকে খাগড়াছড়ির ০৯টি উপজেলায় বন বনানীসহ শতাধিক পাহাড় কেটে সমতলে পরিনত করা হয়েছে। পাহাড়ে এখন প্রতিনিয়ত নানামুখী পরিবেশ বিধ্বংসী অপকর্ম চলমান রয়েছে। ফলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন বন-জঙ্গল কমে গিয়ে, পশু-পাখী তার আবাসস্থল হারিয়েছে। দখল-দূষণে নদ-নদী হ্রদের অস্থিত্ব হুমকিতে পড়েছে, বহু প্রজাতির মাছ ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। দেশে পরিবেশ সংরক্ষণে কঠোর আইন আছে। তবে বাস্তবে তা কমই প্রয়োগ হতে দেখা যায়। মাঝে-মধ্যে জেগে উঠে প্রশাসন, আইনের প্রয়োগ দেখে আমাদের হারানো চির সবুজ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখি। চলমান ২০২৩ইং সালের ৩১ জানুয়ারী এবং ০১ ফেব্রুয়ারী রাঙ্গামাটির ম্লান মুখে হাসির ঝলক দেখেছিলাম। উচ্চ আদালতের আদেশে কাপ্তাই হ্রদ দখল মুক্ত করতে সাড়াশি অভিযান শুরু করেছিল, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ। রাঙ্গামাটি শহরের কয়েকটি এলাকা ছাড়া কাপ্তাই হ্রদের পাড় এখন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গসহ সাধারণ দখলবাজদের কবজায়। অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে হ্রদের পরিধি এখন সংকুচিত হচ্ছে। হ্রদ হারিয়েছে তার রূপ, যৌবন, সৌন্দর্য্য। হ্রদ খেকোদের অবৈধ স্থাপনা থেকে প্রতিনিয়ত মলমূত্র প্লাষ্টিক-পলিথিনসহ নানা ধরণের বর্জ্য হ্রদে পড়ে এর স্বাভাবিক নাব্যতা হারাচ্ছে এবং পানি দুষিত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে হ্রদের জীব-বৈচিত্র। আমাদের প্রিয় কাপ্তাই হ্রদ এখন দখলবাজদের দূষণ নামক মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই মরণব্যাধি থেকে মুক্ত করতে হাই কোর্ট আদেশ দিয়েছে বলে-অতঃপর অপারেশন।
প্রথম দিনের অভিযানে-রাঙ্গামাটির আসামবস্তী, কাপ্তাই সড়কে ও ব্রাহ্মণটিলা এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় দখলদারদের বাঁধার মুখে পড়ে প্রশাসন। তারপর একজন কারবারীর (প্রথাগত চাকমা সার্কেল প্রতিনিধি) এর হস্তক্ষেপে, সন্ধ্যার মধ্যে দখলবাজদের মালামাল সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করা হয়। পরদিন শহরের ফিসারীঘাট বাস টার্মিনাল এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে অসহায় হয়ে পড়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটরা। সেখানে দখলবাজদের বাঁধার মুখে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। পরে দখলবাজরা বিক্ষোভ করতে করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তাঁর অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দখলবাজদের উদ্দেশ্যে বলেন, হাই কোর্টের আদেশ, তাই আইন আইনের গতিতে চলবেই। এখানে আমাদের করার কিছুই নেই। তিনি আরো বললেন, অবৈধ দখল অভিযান চলমান রয়েছে। সকলের সহযোগীতা নিয়ে আগামীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। ইতিমধ্যে সারা দেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশক্রমে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের বহু অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। রাঙ্গামাটিতেও প্রশাসন চাইলে রাঘব বোয়ালদের অবৈধ স্থাপনাগুলো গুড়িয়ে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়। রাঘব বোয়ালদের উপর আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে, চুনোপুঁটিগুলোও এমনিতেই লেজ গুটিয়ে নেবে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে হ্রদের জায়গা দখল করে বেশ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। তারমধ্যে রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়িস্থ ফ্রেন্ডস ক্লাবের ভবনটি- অন্যতম। এ ভবনটি গুড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আবারো নতুনরূপে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হউক-আমরা সেই আশাই করি।
এ দেশে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্শিবাদ ছাড়া অপকর্মে লিপ্ত হওয়া কখনো সম্ভব নয়। পাহাড়ে এখন তাদেরই ছত্র-ছায়ায় বনজ সম্পদ উজার হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কাটাও অব্যাহত থাকায় পশু-পাখী হারাচ্ছে আবাসস্থল। কাপ্তাই হ্রদসহ পাহাড়ের নদ-নদীগুলো এখন তাদেরই ছত্রছায়ায় দখল-দূষণের কারণে ক্ষত-বিক্ষত। যার প্রেক্ষিতে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। যার মাশুল একদিন সবাইকে দিতে হবে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। এতে মানব সমাজেরই চরম ক্ষতি হয়ে যায়। প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ খেকো যেই হোক না-কেন, কোন প্রকার ছাড় দেয়া যাবে না। পরিবেশ খেকোদের না বলুন। উচ্চ আদালতের আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হউক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কারণ আমার দুঃখিনী প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ এখন ভালো নেই- বড্ড অসহায়।
লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।