বিপন্ন প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ এবং ইসলাম
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
………হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সু-যোগ্য কন্যা আমাদের প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পরিবেশ সুরক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল। পরিবেশ সংরক্ষণে দেশে এবং সারা বিশ্বে তিনি প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। অথচ রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের মতো পার্বত্য বান্দরবানের ম্যাকছিছড়া খালটিও দখল করে চলেছেন আমাদের সু-পরিচিত রাজনীতিবিদরা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাব অনুসারে এই খালটির দখলবাজদের সংখ্যা ৮৩ জন। এ তথ্যটি এখন আর সঠিক নয়। যদি সত্যিকারভাবে এখন জরিপ করা হয়, তবে প্রকৃত দখলদারের তালিকায় আরো বহু দখলবাজের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এইসব দখলদারদের তালিকাটি আসলে হাল-নাগাদ নয়। এটি ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে করা হয়েছিল। ম্যাকছিছড়া খালটি আওয়ামীলীগ নেতাদের পাশাপাশি, দখল করেছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র নেতারাও। পাহাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের ইতিহাসের সাক্ষী এ খালের পাড়েই বান্দরবান শহর অবস্থিত। ম্যাকছিছড়া খালের মধ্য দিয়েই সমগ্র বান্দরবান শহরের পানি প্রবাহিত হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ প্রভাবশালীরা খালটি দখল করে, খালের দুই পাশে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য পাকা, আধা পাকা, বানিজ্যিক ও আবাসিক স্থাপনা। ম্যাকছিছড়া খালটি এখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ও সাধারণ মানুষের দখলে ক্ষত-বিক্ষত ও বিপর্যস্ত। দখলবাজদের হাত থেকে এ খালটি উদ্ধার করা এখন সময়ের অন্যতম দাবী।
অন্যদিকে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির বুক ছিড়ে বয়ে চলা চেঙ্গী নদীটিও এখন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পানছড়ি বাজারের সমস্ত ময়লা আবর্জনা প্রতিনিয়ত এ নদীতে নিক্ষেপের কারণে চেঙ্গী এখন প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। চেঙ্গী নদী দূষন মুক্ত রাখতে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মানুষের নির্দয় আচরণে প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ আজ দ্রুত সময়ের মধ্যে বিপন্ন হতে চলেছে। মানবতার ধর্ম ইসলাম প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী প্রদান করেছে। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়কে অত্যান্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআন মজিদে মানুষকে অশান্তি সৃষ্টি না করার জন্য জোর তাগিদ দেওয়া আছে। সুরা আরাফের ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ পাক বলেন, শান্তি স্থাপনের পর তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। অথচ মানুষ প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে। ইদানীং মানুষ নানা প্রজাতীর পাখি থেকে ক্ষেতের ফসল কিংবা সবজি রক্ষার নামে ক্ষেতের চারপাশে সু-কৌশলে কারেন্ট জাল বেঁধে রাখে। অতঃপর ক্ষেতের পাশদিয়ে উড়েঁ যাওয়া নানা প্রজাতির অবুঝ পাখিগুলো কারেন্ট জালে আটকা পড়ে এবং অবশেষে আটকা পড়া পাখিগুলো আর ছাড়া না পেয়ে সেখানেই ধুকেঁ ধুকেঁ মৃত্যুবরণ করছে।
কারেন্ট জালের ফাদেঁ পড়া পেঁচা, বক, শালিক, চড়ুই, মাছরাঙ্গা, ঘুঘু, কলা বাদুরসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর মৃত্যুর পরিনতি, একদিন মানব সমাজের উপর-ই বর্তাবে। এছাড়া বন্য হাতির আক্রমন থেকে ক্ষেতের ফসল, বাগান ও নিজের নিরাপত্তার জন্য মানুষ এখন অ-মানুষের মতো বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পেতে রাখেন। এ সব বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে প্রতিনিয়ত পশু-পাখী, এমনকি হাতিসহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং অমানবিক। এ আদিম বর্বরতার অবসান ঘটাতে আইনের কঠোরতা ছাড়া বিকল্প নেই। মানবতার ধর্ম ইসলামে অযথা পশু-পাখী জীব-জন্তু শিকার অত্যন্ত নিন্দনীয়। বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) বলেছেন, কোন প্রাণীকে লক্ষ্য বস্তু বানিও না; সহিহ মুসলিম। অন্য একটি হাদিসে বর্ণনা আছে, যে ব্যক্তি অহেতুক চড়ুই পাখি মেরে ফেলল, কেয়ামতের দিন সে পাখিটি মহান আল্লাহর কাছে হত্যার অভিযোগ পেশ করে বলবে, হে-আল্লাহ অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে-সুনানে নাসায়ি।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় সবজির নাম বাঁশ কোড়ল। মুলত বাঁশ কোড়ল হলো বাঁশের পাঁচ-ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা প্রাথমিক অবস্থায় বাঁশের কঁচি চারা। এটি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশীর ভাগ মানুষের খাদ্য তালিকায় একটি অন্যতম প্রিয় খাবার। কিন্তু ইদানীং পাহাড়ে বনভূমি কমে যাওয়ায় ও নির্বিচারে বাঁশ কাটাসহ অত্যাধিক পরিমাণে বাঁশ কোড়ল আহরণের ফলে এখানে বাঁশের উৎপাদন কমে আসছে দিন দিন। এভাবে চলতে থাকলে কর্ণফুলী পেপার মিল, বাঁশের তৈরী আসবাবপত্র শিল্পসহ বাঁশ নির্ভর শিল্পগুলো হুমকির মুখে পড়বে। এখন থেকে পাহাড়ের সকল মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং নির্বিচারে বাঁশনিধন ও বাঁশ কোড়ল খাওয়া বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে জুম চাষ। তবু-অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, জুম চাষ প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য একটি ক্ষতিকর বিষয়। প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণে জুম চাষের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অথবা পরিবেশ বান্ধব চাষ অত্যন্ত জরুরী বলে মনে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় পাহাড়ের সকল মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আমাদের প্রজন্মের উপর ভয়াবহ দূর্ভোগ নেমে আসবে। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে মানব জীবনের অস্থিত্বের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের পুরো জীবনটাই প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর নির্ভলশীল এবং অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। তবুও মানুষের সীমাহীন লোভের বেপরোয়া কর্মকান্ডে আজ প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বার-প্রান্তে নিয়ে গেছে। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি বিরূপ আচরণের ফলে মানুষ এখন নানামুখী সংকটে পতিত হচ্ছে। গত ৩১শে অক্টোবর/২০২২ইং তারিখে বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশ করা কান্ট্রি ক্লাইমেট ও ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৩২ শতাংশ মৃত্যুর জন্য পরিবেশ দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং পরিবেশ দূষনের কারণে প্রতি এক লাখের মধ্যে ১৬৯টি শিশু অকালে মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষই বেশীর ভাগ সময় দূষিত বায়ুর মধ্যে অবস্থান করে এবং পানি দূষনের কারণে ডায়রিয়া, কলেরা সহ নানা ধরণের রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশাবাহিত ডেঁঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার মতো রোগে প্রতিনিয়ত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে এ প্রতিবেদনে উঠে আসে। বিশ্ব ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলকে পরিবেশের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে বরেন্দ্র অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূল এবং হাওর অঞ্চল। বিশ্ব ব্যাংকের এ প্রতিবেদন দেশের বিবেকবান মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশের এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা রুম এর ৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ পাক ঘোষনা করেছেন যে, জলে আর স্থলে যতো বিপর্যয়, এর সবই মানুষের নিজেদের কর্মেরই ফল। অতএব, এখন থেকে প্রতিটি মানুষকে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির শতকরা ২৫% ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এ দেশে সরকারী হিসাব মতে মোট ভূমির মাত্র ১৫/১৬ ভাগ বনভূমি রয়েছে। যা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। মূলতঃ প্রকৃত প্রস্তাবে এ দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ০৯ শতাংশ। আবার ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের মতে মাত্র ০৬ শতাংশ। তবুও নির্বিচারে নদ-নদী, হ্রদ দখল-দূষণ, পাহাড় কাটা, বৃক্ষ নিধন সহ চলছে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের নানামুখী মহা-উৎসব।
ফলতঃ এখন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র দেশের এবং তামাম দুনিয়ার পরিবেশে আজ দেখা দিয়েছে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া। ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের মতে বিশ্বের বনভূমি উজার হতে হতে বর্তমানে প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। যার প্রেক্ষিতে পরিবেশ আজ অত্যন্ত হুমকির মুখে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অদুর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের অস্থিত্ব নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্ট মহল। দেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবে। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি মানুষের প্রতিনিয়ত নির্দয় কর্মকান্ডের পরিনামে বণ্যপ্রাণী পশু-পাখি, স্থল ও জলজ প্রাণী, মাছ সহ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ তরুলতা বিলুপ্ত ও বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন তা অব্যাহত থাকলে এক সময় মানব প্রজাতিও বিপন্ন কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষনা থেকে জানা গেছে। এ পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশ ও তামাম দুনিয়ার মানব প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং উন্নয়ন সমৃদ্ধির জন্য অবশ্যই প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে প্রতিটি মানুষকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তাই ইসলামের নির্দেশনাগুলোও যথাযথভাবে পালন সহ আইনের কঠোর প্রয়োগ এখন সময়ের দাবী। এ পার্বত্য চট্টগ্রাম, এ-দেশ এবং তামাম দুনিয়ার বিপন্ন প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত রেখে এ-বিশ্বকে প্রজন্মের বাসযোগ্য করে যাব। এ অঙ্গীকার-ই হউক, আজ আমাদের সকলের। ক্ষমতাবান প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সহ বোধোদয় হউক- সকল মানুষের।
চলবে…………..
লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী