পার্বত্য চট্টগ্রাম হোক-এক স্বপ্নের পর্যটন শিল্পের সেরা জনপদ
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
রূপ বৈচিত্রের এক অনন্য ভান্ডার আমাদের প্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। উঁচু নিচু সবুজ পাহাড়ের পাশে আঁকা-বাঁকা পথ আর পাহাড়ের বুক চিঁরে আঁছড়ে পড়ছে অবিরাম জলরাশি। শত শত ঝর্ণা, বহু পাহাড়ী ছড়া, আঁকা-বাঁকা নদ-নদী, খাল-বিল নয়নাভিরাম হ্রদের অপরূপ সৌন্দর্য্যে ভরপুর এ মায়াময় পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রকৃতির আকর্ষণীয় সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় তিন পার্বত্য জেলা যেন রূপকথার গল্পের এক স্বর্গরাজ্য। এখানের পর্যটন শিল্পতো অশ্বগতিতে এগিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কচ্ছপ গতির পরিবর্তন হয় নাই। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পাহাড়ে এ খাতে যে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু হয় নাই বলেই আমরা উদ্বিগ্ন। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে পর্যটন শিল্পে কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে বান্দরবান জেলায়। যে তুলনায় পিছিয়ে আছে খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটি। দীর্ঘকাল যাবৎ পর্যটন শিল্পে সু-পরিকল্পিত ভাবে উন্নয়ন না-হওয়ায় এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
পাহাড়, খাল, নদী-নালা, বিল, হ্রদ এবং ঝিরি-ঝর্ণা, ছড়ার মাঝে সবুজের অকৃত্রিম মহা-মিলনের পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটকদের আকর্ষনের বহুবিধ বিষয় ও নানা উপকরণ এখানে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া। বিধাতার অকৃত্রিম করুনায় প্রদত্ত পর্যটকদের আকর্ষনের এসব উপকরণগুলো মনের মাধুরী মিশিয়ে আকর্ষনীয় করে সাজিয়ে পর্যটন স্পট গড়ার দায়িত্ব যাদের, পিছিয়ে পড়া এ অপার সম্ভাবনাময় খাতে ব্যর্থতার দায় সরাসরি তাদের উপর-ই বর্তায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সরকারের যথাযথ উদ্যোগের অভাবেই এ খাতটি এখন মারত্মকভাবে অবহেলীত। প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর জাতি সংঘের অধীনস্থ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সকল সদস্য দেশে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালন হয়ে আসছে। ১৯৮০ সাল থেকে দিবসটির সুচনা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পর্যটন কেন্দ্রের সাথে সেতু বন্ধন গড়ে তোলা দিবসটির মূল উদ্দেশ্য। এছাড়াও পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য। আধুনিক বিশ্বে অস্ত্র ও তৈল শিল্পের পর তৃতীয় অর্থ আনায়নকারী শিল্প-পর্যটন খাত। বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের বহু দেশের প্রধান আয়ের উৎস্য এ পর্যটন শিল্প।
মালদ্বীপ, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, সিঙ্গাপুর, মাদাগাস্কার এবং সমস্ত ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রধান আয় আসে পর্যটন খাত থেকে। শিল্পটি এখন সারাবিশ্বে অর্থনীতির মুকুট হিসাবে পরিচিত লাভ করেছে। এ শিল্প ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং প্রতি আড়াই সেকেন্ডে ০১টি কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করে। ০১ জন পর্যটকের আগমনে সেবা খাতে ১১জন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান ৩৩ জন মানুষ। অর্থাৎ এক লাখ পর্যটকের আগমনে ১১ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের গবেষনায় উঠে আসে। গবেষনায় আরো জানা গেছে যে, অনুন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যটন স্পট সংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাড়তি আকর্ষন তৈরী না-করা, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিনোদনের আয়োজন না-করা, পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রভাব, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সরকারের সু-নজর না-থাকায় এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের কাঙ্কিত উন্নয়ন হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় এসব ক্ষেত্রে নজর দেয়া এখন সময়ের বাস্তব দাবী।
সুদীর্ঘ কাল থেকে পাহাড়ে এ শিল্পের বিকাশে আলোচনা হয়, পরিকল্পনাও হয় অনেক। ওরা আমাদের স্বপ্ন দেখায়। আমরা স্বপ্ন দেখি বার বার। কিন্তু আমাদের দুঃর্ভাগ্য যে, সে স্বপ্ন মিছে হয়ে অবশেষে বেদনায় পরিনত হয়। মেঘ, পাহাড়, নদী-নালা, খাল-বিল, ঝিরি-ঝর্ণা, হ্রদ এবং সবুজের এ জনপদে প্রকৃতি তার সব রূপ, লাবন্য, সজিবতা অপার হস্তে দান করেছেন। প্রকৃতির এসব অসীম দান সমূহ কাজে লাগিয়ে যদি, নিত্য-নতুন পর্যটন স্পট সৃষ্টি করা যায়, তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম হবে বাংলার শ্রেষ্ঠ একটি পর্যটন এলাকা। পার্বত্য বান্দরবানে জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পর্যটন শিল্পে কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে। বান্দরবানের বাংলার দার্জিলিং খ্যাত চিম্বুক, নীলগিরি, তমাতুঙ্গী, নীলাচল, মেঘলা, ডিম পাহাড়, প্রান্তিকলেক, বগালেক, জাদিপাই ঝর্ণা, দামতুয়া, শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, রিজুকঝর্ণা, চিংড়ি ঝর্ণা, বাকলাই ঝর্ণা, সাতভাইকুম, রেমাক্রী, দেবতাকুম, নাফাকুম, বৌদ্ধ টেম্পল, রামজাদী ও স্বর্ণ মন্দিরের মত পর্যটন স্পটগুলো অন্যতম। খাগড়াছড়ি জেলায় কিছু পর্যটন স্পট ছাড়াও আলুটিলাকে অন্যতম পর্যটন স্পট হিসাবে গড়ে তুলেছেন জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়।
রাঙ্গামাটি জেলায় রাঙ্গামাটি পার্ক, ডিসি বাংলো পার্ক, পলওয়েল, আরণ্যক, আসামবস্তী-কাপ্তাই সড়কের পাশে নির্মিত কয়েকটি রিসোর্ট, কাপ্তাই উপজেলায় কিছু পর্যটন স্পট, বিলাইছড়ির নীলাদ্রি রিসোর্ট, শিশু পার্ক ও ঝুলন্ত ব্রীজ, বরকল উপজেলার সুবলং এর প্রাকৃতিক ঝর্ণা। এছাড়া বাঘাইছড়ির মেঘের দেশ সাজেকের কিছু রিসোর্টসহ পর্যটন স্পট উল্লেখ্যযোগ্য। তারুন্যের ছোঁয়ায় রাঙ্গামাটিতে এখন চোখে পড়ার মতো কিছুটা উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে। নিত্য নতুন পর্যটন স্পট, দ্বীপ কটেজ, হাউজ বোট, রেষ্টুরেন্ট, ট্যুরিষ্ট বোট এবং ট্যুরিষ্ট গাইডে ও তরুনদের অংশগ্রহণ এ-শিল্পকে আলোকিত করেছে। মূলতঃ তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন শিল্পের যে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা কিন্তু হয় নাই। এ খাতে যতটুকু বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিগণের সদিচ্ছা এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সাদা মনের অবদান।
যা সত্যি-ই অত্যন্ত প্রশংসার দাবী রাখে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে উপকরণ কিংবা বিষয় সমূহ কাজে লাগিয়ে কৃত্রিমভাবেও এ অপার সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশ সাধন অসম্ভব কিছু নয়। রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের কলাবাগান এলাকায় দুর্গম পথে বেশ কয়েকটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক ঝর্ণা অনাদারে পড়ে আছে। তবু-ও দৃষ্টি নন্দন ঝর্ণাগুলোর আকর্ষণে সেখানে প্রতিদিন দূর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসে অসংখ্য পর্যটক। কলা বাগানের ঝর্ণাগুলো কাজে লাগিয়ে বড় ধরণের একটি পর্যটন স্পট গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করি। সিম্বল অব রাঙ্গামাটি খ্যাত জেলার বৃহত্তম পর্যটন স্পট ঝুলন্ত সেতুতে চার দশকেও কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বর্ষাকালে কাপ্তাই হ্রদের পানি অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে সেতুটি পানির নিচেই তলিয়ে যায়। একযুগ ধরে ঝুলন্ত সেতুর ভাগ্যে এই নির্মম মৌসুমী পরিনতি চলমান। বিষয়টি নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা হয় কিনা আমার জানা নেই। ১৯৮৫ সালে ৩০ একর জায়গা নিয়ে কাপ্তাই হ্রদের উপর তৈরী করা হয় পর্যটন স্পট এবং ৩৩৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে এ ঝুলন্ত সেতু। এ সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের মতে, এটি আর উপরে তোলা সম্ভব হবে না। কারণ সেতুর পিলারের সাথে যে তার সংযোজন পুর্বক ওয়েট ব্যালেন্স টিক করা আছে। এ অবস্থায় এখন সেতুটি উপরে তুলতে গেলে ওয়েট ব্যালেন্স থাকবে না।
অতএব, আরো আকর্ষনীয় করে সৌন্দর্য্যবর্ধন পূর্বক নতুন ঝুলন্ত ব্রীজ নির্মাণ ও ওয়াশ রুমের ব্যবস্থা এবং রাস্তা ঘাট সহ সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। বর্তমানে বাঘাইছড়ির সাজেকে পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় সাজেকে আরো রিসোর্ট ও গাড়ী পার্কিং এর জায়গা তৈরী এবং স্থায়ী ভাবে পানির সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হলে এ খাতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে অগ্রসর হতে হবে। উন্নত দেশের মতো পাহাড়ের চুড়ায় নয়নাভিরাম স্থাপনা কিংবা ক্যাবল কার তৈরীর বিকল্প নেই। আসলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করাটা নির্ভর করে সম্প্রীতি, নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত এবং উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের উপর। আমরা বিশ্বাস করি, পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন এবং সর্বস্থরের মানুষ যদি এগিয়ে আসে, অশ্বগতিতে এগিয়ে যাবে পাহাড়ের পর্যটন শিল্প।
রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটন শিল্পের বিকাশে ১২০০ কোটি টাকার ০১টি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানা যায়। এভাবে বহুকাল যাবৎ অনেকেই অনেক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। শেষে পরিকল্পনা গুলো আর আলোর মুখ দেখে নাই। তবুও পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে পড়া রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িকে প্রধান্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে তিন পার্বত্য জেলাকে ঘিরে মহা-পরিকল্পনা গ্রহণের এবং তা দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই। আমরা নতুন করে আর বলতে চাইনা যে, এ চির সবুজ পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় এক বৈচিত্রপূর্ণ জনপদ। দেশের সংবিধানে বিনোদন, ভ্রমন ও বিশ্রামের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমরা আশা করি সরকার সংবিধানের মৌলিক অধিকার পুরণ করতে সচেষ্ট থাকবে। পরিশেষে- এ পার্বত্য চট্টগ্রাম হোক এক স্বপ্নের পর্যটন শিল্পের সেরা জনপদ। এ- প্রত্যাশা-ই করি।
লেখক: মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।