স্বাস্থ্যসেবায় ভরসা তিন কিলোমিটার দূরের ওষুধের দোকান
খাগড়াছড়ির লাইফু কার্বারী পাড়ায় নেই শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
॥ দহেন বিকাশ ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি ॥
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের তবলছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম লাইফু কার্বারী পাড়া। ১৭০ পরিবার নিয়ে গঠিত গ্রামে রয়েছে প্রায় আটশত জনের বেশি জনসংখ্যা। এই গ্রামের ১০০ শতাংশ মানুষই ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের। সবদিক থেকেই পিছিয়ে আছে এই গ্রাম। বিদ্যুৎ নেই, আশপাশের বিদ্যালয়ও নেই। স্বাস্থ্যসেবায় ভরসা তিন কিলোমিটার দূরের তবলছড়ি বাজারের ওষুধের দোকান। চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয় না। আয়-রোজগারের একমাত্র পথ পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি ও জুমচাষ। যাদের জায়গা জমি আছে তারাই কচু, হলুদ ও কলা চাষ করে। এটাও হাতে গোনা কয়েকজন।
একসময় নিজস্ব জায়গায় কৃষি জমি ও পাহাড়ে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে, তা বিক্রি করে সংসার চালাতেন এখানকার বাসিন্দারা। এখন অধিকাংশ সেখানেই অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা জোরপূর্বক দখল করে ভোগ করছে। নিজস্ব ভূমি হারিয়ে দিশেহারা পাড়ার বাসিন্দারা। অনেকেরই খেয়ে না খেয়ে চলছে দিন। সম্প্রতি (গত ১০ সেপ্টেম্বর) লাইফু কার্বারী পাড়া ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ের টিলায় তৈরি ত্রিপুরাদের জরাজীর্ণ অসংখ্য ঘরবাড়ি, কারো মাটির তৈরি গুদাম ঘর, কারোর বা ছনের। ছেলেমেয়েরা ঘরের আঙিনায় খেলাধুলায় ব্যস্ত। অধিকাংশ শিশুর খালি গা। কিছু নারী-পুরুষ পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে খোলা মাঠে স্তূপ করছেন। কেউ আবার পাহাড়ি জমিতে জুম চাষে ব্যস্ত।
পাড়ার কার্বারী কলেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (৫৫) জানান, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই এই গ্রামে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পরিবারের বসবাস। অথচ এখনো এই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। গ্রামে নেই ইট বিছানো কোনো রাস্তা। নেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একসময় এলাকার সকল পাহাড় ও জমি ত্রিপুরাদের থাকলেও এখন আর সেই দিন নেই। একসময় পাহাড়ে জুম চাষ ও জমিতে চাষ করে চলতো সংসার। বর্তমানে এটিও হারিয়েছেন। অভাব-অনটনেই চলছে অনেক পরিবারের সংসার। তবে বিগত ২০২১সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি আসনের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সুপারিশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রয়োজন নিয়ে আবেদন দেওয়া আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই পাড়ার আশপাশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। কয়েকজন ছেলে পাশের খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়নের ভাগ্য কার্বারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শুকনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে লোখাপড়া করছে। গ্রামের অনেক ত্রিপুরা শিশুকিশোর পড়ালেখা করতে পারছে না।
পাড়ার বাসিন্দা চম্পা রানী ত্রিপুরা (২৪) বলেন, অনেক কষ্টে এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। এইচএসসি শেষ করার পিছনে রয়েছে অনেক সহিংসতার গল্প। একই ক্লাসের ভিন্ন সম্প্রদায় কর্তৃক সহিসংতার শিকারের কথা জানান তিনি। লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো চলাফেরা করার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অভাবের সংসার ও ইভটিজিং, সহিসংতা শিকার এসবই প্রধান বর্তমানেও গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী আমার মতোই এসবের শিকার হয়। গ্রামে একটা প্রাথমিক স্কুল তৈরি হলে পাড়াবাসীর জন্য সুবিধা হতো বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি সাংগঠনিক এক সফরে গিয়ে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস্ ফোরাম, বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অঞ্জু লাল ত্রিপুরাও বাস্তব চিত্র তুলে ধরে বলেন, লাইফু কার্বারী পাড়া বাসিন্দারা অত্যন্ত গরিব ও অবহেলিত। এখানে নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়, নেই কোন ছাত্রীদের নিরাপত্তা। এছাড়াও নারীরা ইভটিজিংয়ের শিকার, জায়গা সংক্রান্ত সমস্যা ও নিরাপত্তাহীনতা। গ্রামে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক স্থাপনের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন এ ছাত্র নেতা।
এ ব্যাপারে তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোঃ আবুল কাশেম ভুইয়া জানান, লাইফু কার্বারি পাড়ার বাসিন্দারা অত্যন্ত গরিব। সকল সমস্যা আসলেই ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তারপরও ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
চেয়ারম্যান আরো বলেন, পাড়ায় শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক স্থাপনের ব্যাপারে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে বলে জানান।