দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন-পুলিশের কাজ, আপনি যদি ক্রিমিনাল না হন, তবে-এতো ভয় কেন ?
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
হিংস্রতার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে অভাগা পার্বত্য চট্টগ্রাম। স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি সবুজের চাদরে ঢাকা এ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি তিন পার্বত্য জেলায় আজও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অপার সম্ভাবনাময় এই চির সবুজ পার্বত্য চট্টগ্রাম পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের আগেও ছিল এক ভয়ানক অশান্ত জনপদ। তবে-শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ে কিছুটা হলেও সন্ত্রাসের মাত্রা কমে আসে। কিন্তু দূর্ভাগ্য জনক ভাবে ডিসেম্বর ২০১৭ সাল থেকে আবারো স্বপ্নীল পাহাড়ে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠে। সবুজের চাদরে ঢাকা পাহাড় আবারো রক্তাক্ত হতে থাকে। বারুদ আর লাশের গন্ধে পাহাড়ের বাতাশ ভারী হয়ে উঠে। দিনের পর দিন বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, গুম, খুন, অপহরনে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারীদল আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী, মহান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কর্তব্যরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একের পর এক অতর্কিত হামলা। এমনকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রেহায় পাচ্ছেন না। ঠিক তখন থেকে পাহাড়ের অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার প্রয়েজনে সরকারের নিকট একের পর এক সেনা ক্যাম্প প্রতিস্থাপনের জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-চুক্তির ধারা বা শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে ২৪০ টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেন। অতঃপর সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে আরো বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এর প্রেক্ষিতে সরকার অনেক চিন্তা-ভাবনার পর পাহাড়ের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা পূর্বক, বলতে গেলে বাধ্য হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন) স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।
এমতবস্থায়, পার্বত্যবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে নেয়া এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৬ মে ২০২২ইং তারিখে শহরের নিউ পুলিশ লাইন রাঙ্গামাটিতে এপিবিএন এর আঞ্চলিক সদর দপ্তরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, এমপি। তিনি তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে বলেছেন-এপিবিএন স্থাপন শান্তি চুক্তির সাথে প্রাসঙ্গিক কোন বিষয় নয়। পাহাড়ের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের স্বার্থে পুলিশের একটি শাখাকে এখানে মোতায়ন করা হচ্ছে। মূলতঃ আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্যিকার অর্থে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বন্ধ হয়নি বিচ্চিন্নতাবাদী আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রসীদের চাঁদাবাজি, অপহরন, গুম এবং হৃদয় বিদারক অমানবিক হত্যাকান্ড। দূর্গম পাহাড়ের অভ্যন্তরে যাতায়াত ও অবস্থান আজও নিরাপদ না হওয়ায় হত্যা, নিপীড়নের অধিকাংশ খবর এখনো অজানা থেকে যায়। পার্বত্য শান্তি চুক্তির শর্ত অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে অ-প্রয়োজনীয় সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর অঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দৌড়াত্ব কমেনি। পাহাড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজও অঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে নিরীহ সাধারণ মানুষ বড়-ই অসহায় অবরুদ্ধ এবং তাঁদের অধিকারগুলো জিম্মি হয়ে আছে। বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি নাজুক। এই অবস্থায় পাহাড়ের নিরীহ মানুষের, সরকারের কাছে বাঁচার তাগিদে সেনা ক্যাম্প প্রতিস্থাপনের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক এবং ন্যায্য বলেও মনে করেন। কারণ-সরকারের সাথে পিসিজেএসএস (সন্তু) এর শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হলে কাগজে কলমে শান্তি বাহিনী বিলুপ্ত হয় এবং তাদের কিছু সংখ্যাক সশস্ত্র বিদ্রোহী আত্ম-সমার্পন করেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আজও পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে নানাভাবে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। বর্তমানে চুক্তিস্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ-গনতন্ত্র, পিসিজেএসএস-সংস্কার, মগ পার্টি এবং নবসৃষ্ট কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সহ পাহাড়ে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের দেশী-বিদেশী অস্ত্রের মহড়া দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলো প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো হতে অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষন নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে এবং দেশ, জনগন, সরকার ও পার্বত্য বাসীর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পার্বত্য শান্তি চুক্তিস্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস সহ তার সকল জনগোষ্ঠি সরকারের শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের সকল সুফল এবং সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পরেও অদ্যাবধি শান্তি চুক্তির অপর পক্ষ হিসেবে তারা চুক্তির মৌলিক শর্তও পর্যন্ত এখনো বাস্তবায়ন করেনি। তবুও সরকার এখনো পর্যন্ত চুক্তিস্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস (সন্তু) কে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন এর অভিযোগে অভিযুক্ত করেনি। আসলে সরকার তাদের প্রতি অত্যন্ত উদার, ধর্য্যশীল, সহনশীল এবং আন্তরিকও বটে। ফল শ্রুতিতে-এক তরফা ভাবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৯০% শর্ত বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু অপরপক্ষ পিসিজেএসএস (সন্তু) চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘনের পরেও আজও দেশ, জনগন, সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে ঘটনাপুঁঞ্জিগুলো তার স্বাক্ষ্য বহন করছে। এখন তারা সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয় এবং পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে এপিবিএন প্রতিস্থাপন কে শান্তি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন বলে মিথ্যা বানোয়াট অপপ্রচারে লিপ্ত থেকে দেশে এবং বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার অপচেষ্ঠা চালাচ্ছে। আসলে সন্ত্রাসীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভয় পায়। পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প প্রতিস্থাপন হলে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা বাধাগ্রস্থ হবে। এই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অলীক স্বপ্নের মগের মুল্লুকে পরিনত করার কল্পকাহিনী বাস্তবে চিত্রায়িত হবে না বলে তাদের এতো বানোয়াট অভিযোগ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির জানমালের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে পার্বত্যবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবীর মুখে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এপিবিএন প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি কোন ক্রমেই পার্বত্য শান্তি চুক্তির বরখেলাপ নয়। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে পাহাড়ের সার্বিক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন তৎকালীন সরকারের প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র সরকারের সাথে পিসিজেএসএস (সন্তু) এর সাথে দ্বি-পাক্ষিক শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। উভয়ের সম্পাদিত সেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। যে কোন দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির কিছু শর্ত প্রথম পক্ষের উপর এবং কিছু শর্ত দ্বিতীয় পক্ষের উপর প্রযোজ্য। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশরত্ন প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র সরকারের আন্তরিকতার ফলে পার্বত্য শান্তি চুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পার্বত্যবাসির দূর্ভাগ্য যে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষ পিসিজেএসএস তাঁদের মৌলিক শর্তটিও বাস্তবায়ন না করে প্রতিনিয়ত শান্তির পাহাড়ে অরাজকতা সৃষ্টি করে চুক্তি বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয় অপার সম্ভাবনাময় স্বপ্নের পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি স্বাক্ষরকারী পিসিজেএসএস (সন্তু) এর আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র গ্রুপ ছাড়াও আরো পাঁচটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের অস্ত্রের ঝনঝনানীতে পার্বত্য বাসির জান-মাল সহ সার্বিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তার প্রয়োজনে যখন সরকারের কাছে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান। তখন সরকার জনগনের দাবির মুখে সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এপিবিএন ক্যাম্প প্রতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে পুলিশ ক্যাম্প বসানো যাবে না, আমার জানামতে এমন কোন শর্ত চুক্তিতে নেই। এপিবিএন পুলিশের একটি বিশেষ শাখা। তাই এখানে “দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন” পুলিশের কাজ, আপনি যদি ক্রিমিনাল না হন, তবে-এতো ভয় কেন ? দেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে আমরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অতিষ্ট জনসাধারণ পাহাড়ে এপিবিএন প্রতি স্থাপনকে স্বাগত জানাই।
লেখক:- মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী