চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ জেএসএস সহ পাহাড়ের সকল আঞ্চলিক সংগঠনের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত হউক, শুভ বুদ্ধির উদয় হউক
॥ মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ) ॥
চাঁদাবাজি আর অপহরণ বানিজ্যকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পি.সি.জে.এস.এস (সন্তু), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ,(প্রসিত), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পি.সি.জেএসএস,(এম,এন,লারমা), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ,(গনতান্ত্রিক) ও বান্দরবান সংশ্লিষ্ঠ মগ লিবারেশন পার্টির সশস্ত্র ক্যাডারদের তৎপরতা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইদানীং কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কে.এন.এফ) নামক আরও একটি সশস্ত্র সংগঠনের আর্বিভাব হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে সন্তুলারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)’র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য এ চুক্তি, শান্তিকামী মানুষ এবং দেশ-বিদেশের কাছেও প্রশংসিত। চুক্তির ৭২ টি ধারা ও ৯৯ টি উপধারা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে সন্তুলারমা সহ শান্তি বাহিনীর কিছু সংখ্যক সশস্ত্র ক্যাডার অস্ত্র সর্মপনের মধ্য দিয়ে শান্তি বাহিনী নামক তাদের সশস্ত্র সংগঠনের বিলুপ্ত ঘোষনা করা হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেই দিন সন্তু লারমাকে বিশ্বাস ঘাতক আখ্যায়িত করে জেএসএস এর একটি বিশাল অংশ প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। তারাও জেএসএস এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড গঠন ও শায়ত্ব শাসনের দাবীতে আন্দোলন সংগ্রামের নাম করে চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণ বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আধিপত্য বিস্তার কে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে সশস্ত্রনির্ভর শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতি চরম সংঘাত। জনশ্রুতি লাভ করে যে, এতে রক্তাক্ত পাহাড়ী জনপদ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ পাহাড়ী এলাকা অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় এখানে চাঁদাবাজি ও অপহরণ বানিজ্যের বড়ক্ষেত্রের মধ্য দিয়েই খুব সহজেই ব্যাপক অর্থ আয়ের সুযোগ করে নেয়। এটিকেই বড় বাণিজ্য ধরে পাহাড়ে গঠিত হয়েছে নিত্য নতুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। শান্তি চুক্তির পর জেএসএস (সন্তু) ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে ইউপিডিএফ। ২০০৫ সালে জেএসএস আরেক দফা ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমা)। ২০১৯ সালে শুধু মাত্র বান্দরবান জেলায় হঠাৎ গড়ে উঠে মগ লিবারেশন পার্টি নামে আরেকটি সশস্ত্র সংগঠন। এর পর ২০২০ সালে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে গঠিত হয় ইউপিপিএফ (গনতান্ত্রীক)। সর্বপরি ইদানিং আরেকটি সশস্ত্র সংগঠনের আবির্ভাব ঘঠে যার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। বান্দরবান থেকে কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠা হলেও তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু সংখ্যক উপজেলাতে বর্তমানে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। শুধু তাই নয় বন্দরবানের দূর্গম পাহাড়ে কেএনএফ এর চাঁদাবাজী দিন দিন বিস্তৃতিও লাভ করছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের সভাপতি নাথান বম ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বান্দরবান জেলা থেকে অংশগ্রহন করেন। কেএনএফ এর অপতৎপরতা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন গনমাধ্যমে বেশ-কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সরকারকে আবারো নতুন করে ভাবতে হবে বলে সংশ্লিষ্ঠ মহলও মনে করেন। মূলত শান্তিচুক্তির ধারা ও শর্ত অনুসারে চুক্তি স্বাক্ষর পূর্বক আত্ম-সমর্পন এবং অস্ত্র সমর্পনের পর পাহাড়ে আর কারো হাতে কোন প্রকার অবৈধ অস্ত্র থাকার কথা নয়।
কিন্তু আজ শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে এসব সশস্ত্র সংগঠনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে রয়ে গেছে সর্বাধুনিক দেশী-বিদেশী অজশ্র ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। যা-ব্যবহার করা হচ্ছে সামরিক বেসামরিক সহজ সরল সাধারণ মানুষের বুকে, আর ভ্রাতৃঘাতি রক্তাক্ত সংঘাতে। প্রতিবছর চাঁদাবাজি আর অপহরণের মাধ্যমে এসব সশস্ত্র সংগঠনের কোটি কোটি টাকা আয় হয় বলে জানা যায়। যা-এখানকার সাধারণ মানুষ পেশাগত কারণে পেটের দায়ে প্রানের ভয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার তাঁর চুক্তির লক্ষ্য বা ধারা বাস্তাবয়নের জন্য গত ২৬ মে ২০২২ইং তারিখ রাঙ্গামাটির শুখীনীলগঞ্জস্থ নিউ পুলিশ লাইনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এতে তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে, যার হেড কোয়াটার্স হবে রাঙ্গামাটিতে। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এমপি, পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীন অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। দেশের গুরুত্বপূর্ন উর্ধ্বতন এই ০৩ কর্তা ব্যক্তির বক্তব্যে পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে বলেই মনে হচ্ছে। পাহাড়ে রক্তপাত-চাঁদাবাজি বন্ধে এবং শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যা করার প্রয়োজন সব-ই করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২ টি ধারা ও ৯৯ টি উপধারার মধ্যে সবগুলো সরকারের জন্য পালন যোগ্য। এই সব ধারাগুলোর মধ্যে কেবল মাত্র ২টি ধারা বাস্তবায়ন চুক্তিস্বাক্ষরকারী অপর পক্ষের উপর প্রযোজ্য।
মূলত সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির ধারা এবং উপধারাগুলো বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে বলেও বলা হচ্ছে। কিন্তু অপর পক্ষের সকল সশস্ত্র ক্যাডারদের আত্মসমর্পন ও অস্ত্র জমাদানের শর্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীন। পুলিশের আইজিপি ড.বেনজীর আহমেদ দেশের বৃহত্তর অংশে সন্ত্রাস জঙ্গি ও চাঁদাবাজি দমন করার কথা উল্লেখ করে সকলের সহযোগীতার মাধ্যমে পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন। আজ থেকে ২৫ বছর আগে পাহাড়ে জনসংহতি সমিতি এবং এর সশস্ত্র ক্যাডার ছাড়া আর অন্য কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন ছিল না। কিন্তু আজ জেএসএস (সন্তু) ছাড়া আরো ৫টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনের অপ-তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চুক্তিস্বাক্ষরকালীন সময়ে আসলে কি! জেএসএস (সন্তু) এর সকল অস্ত্রধারী সদস্যরা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করেছিল? এই প্রশ্ন আজ সর্বত্র। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে জেএসএস (সন্তু) এর সকল সশস্ত্র সদস্যরা অস্ত্র সহ অদ্যবধি আত্মসমর্পন করেনি। হয়ত অলীক স্বপ্নের কারনে তাদের এমন-ই সিদ্ধান্ত। যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল, অত্যন্ত কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আন্তরিকতাকে আর বেশী দিন দুর্বলতা মনে করার মানে-“বোকার স্বর্গে বসবাস”। আজ পার্বত্যবাসী সহ সমগ্র বাংলার মানুষের মনে একটি প্রশ্ন-ই বার বার জেগে উঠে, কেবল মাত্র সরকার-ই কি-এক তরফা চুক্তি বাস্তবায়ন করবে?
চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপরপক্ষের মাত্র ২টি ধারা বাস্তবায়নের কি-দায় নেই? আজ চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষের সকল সশস্ত্র ক্যাডারদের নিয়ে অস্ত্র সহ আত্মসমর্পন করা ছাড়া আর কোন পন্থা নেই বলে আমি মনে করি। এটা সময়ের বাস্তব দাবী। আমাদের প্রত্যাশা-জেএসএস (সন্তু) সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। “সব ভালো যার শেষ ভালো তার”। কিন্তু জেএসএস এর সব ভাল নয়। তবুও শেষ ভালো-ই হোক জেএসএস এর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তি বর্গের সাথে তাদের খোলা-মেলা আলোচনার উদ্দ্যেগ নেয়া যেতে পারে। শান্তি চুক্তির বয়স এখন ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। সেই সময়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আর ডিজিটাল দেশের সার্বিক উন্নয়নের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। তাই-চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ জেএসএস সহ পাহাড়ের সকল আঞ্চলিক সংগঠনের হর্তা-কর্তা সশস্ত্র ক্যাডারদের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত হউক, শুভ বুদ্ধির উদয় হউক। আমাদের এটা-ই প্রত্যাশা রইল। তারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে বেরিয়ে আসুক। তা না হলে অদুর ভবিষ্যতে এর পরিনতি অত্যন্ত ভয়ানক রূপও নিতে পারে। যাদের দায় তাদের-ই বহন করতে হবে অনন্তকাল। তবে আমাদের সকলের-ই মনে রাখা উচিৎ- এই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত একটি টিলায় ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ট ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ, যিনি পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশত আটানব্বই বর্গমাইলের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন এই বাংলাদেশ এবং দেশের সর্বস্তরের জনগনের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী অস্ত্রধারীদের প্রলয়নাচন কোন কালে-ই শুভ নহে। অশুভ শক্তির পরাজয় চিরদিন-ই হয়। এটা-ই চির সত্য। আসুন পাহাড়ের ইতিহাস ফুলে-ফুলে লিখি, নিরীহ মানুষের রক্ত নিয়ে নয়।
লেখক:- মোঃ সিরাজুল হক (সিরাজ)
কবি, কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক কর্মী।