আইডিএফসহ সরকারি-বেসকারি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায়
হালদা পাড়ে বেড়েছে মালচিং পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজসহ বিভিন্ন জাতের চাষাবাদ
মোঃ ইসমাইল হোসেন, মানিকছড়ি ॥
‘বঙ্গবন্ধু হেরিটাইজ’ খ্যাত হালদা নদী দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন ক্ষেত্র। নদীতে মাছের উৎপাদনশীলতা রক্ষা ও বৃদ্ধির লক্ষে সরকারের গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। বিশেষ করে বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষি বিভাগ ও আইডিএফসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নানা উদ্যোগের ফলে হালদার উজান মানিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কমে এসেছে তামাকের চাষাবাদ। যেসব এলাকায় বিশাল মাঠ জুড়ে এক সময়ে তামাকের চাষবাদ হতো সেখানেই এখন বারো মাসি তরমুজসহ বিভিন্ন প্রকার দেশি-বিদেশী শাকসবজি চাষাবাদ করছেন স্থানীয় কৃষকরা। বিভিন্ন সংস্থাগুলোর ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে সম্প্রতিক সময়ে হালদায় বিশাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গতকারী তামাক চাষ কমে আসায় প্রাকৃতিক সতেজতা ফিরতে শুরু করেছে। তামাক চাষিদের বিকল্প জীবিকায়নের লক্ষে মানিকছড়ি উপজেলার গোরখানা, আছাদতলী, ছদুরখীল ও কালাপানি এলাকার চাষিরা ঝুঁকছে বিভিন্ন শাক-সবজি চাষে। তারই অংশ হিসেবে উপজেলার গোরখানা এলাকার ২০-২৫ জন কৃষক তামাক চাষ ছেড়ে আইডিএফ ও পিকেএসএফের সহযোগিতায় নিয়ে মালচিং পদ্ধতিতে উচ্চ মূল্যের গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ শুরু করেছে। সেই সাথে এসব এলাকায় সবজিসহ অন্যান্য চাষাবাদের উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এক সময়কার তামাক চাষীরা বর্তমানে সবজি ও মৌসুমী চাষাবাদে সফলতা বয়ে আনছেন। বদলে গেছে হলদা পাড়ের চিত্র। যেখানে তাকালেই তামাকের বাম্পার ফলন দেখা গেলেও বর্তমানে সেখানে ভিন্ন চিত্র লক্ষ করা যায়। বর্তমানে বারো মাসি তরমুজসহ বিভিন্ন জাতের মৌসুমী চাষাবাদ লক্ষ করা যায়। দীর্ঘদিন যাবৎ হালদা পাড়ে তামাক চাষ করে আসলেও সম্প্রতি হালদা রক্ষা কমিটির পরামর্শ ও সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় তামাক চাষ ছেড়ে মালচিং পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ ও বিভিন্ন জাতের দেশি বিদেশি সবজির আবাদসহ তামাকে বিকল্প চাষাবাদে ঝুঁকছেন তারা। এতে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি কমেছে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদিত শাক-সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে সেখানকার উৎপাদিক ফসল। অর্থনৈতিকভাবেও স্বাভলম্বী হচ্ছেন অনেকেই।
স্থানীয় কৃষক মোঃ খোরশেদ আলম জানান, এখানকার অসংখ্য কৃষক তামাক চাষে নিঃস্ব হয়েছে। প্রথমত সরকারি-বেসকারি সংস্থার নানা উদ্যোগকে গুরুত্ব না দিলেও বর্তমানে তামাকের বিকল্প চাষাবাদের সফলতা দেখে অনেকেই তরমুজ চাষাবাদে আগ্রহী হয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন হালদা নিয়ে কাজ করা আইডিএফ প্রকল্প থেকে। শুরু করছেন তরমুজ চাষ।
তরমুজ চাষি মো. চাঁন মিয়া, কোম্পানীর প্রলভনে দীর্ঘদিন ধওে আমরা তামাক চাষাবাদ করে আসছিলাম। কিন্তু তাতে আমরা আর্থিক ভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এছাড়াও স্বাস্থ্য ঝুকিতেও এলাকার অনেক মানুষ।
কৃষক আলী মিয়া ও ফারুক হোসেন বলেন, অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে ও কোম্পানীর প্রলববে পড়ে এলাকার অনেক মানুষ তামাকের চাষাবাদ করেছে। দুয়েকজন লাভবান হলেও বেশির ভাগই আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অনেকেই শাসকষ্টসহ নানা রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও হালদার উজানে এমন ক্ষতিকর তামাক চাষ করা ঠিক না বলেই আমরা চিন্তা করে এর চাষাবাদ বন্ধ করেছি। তাই বিকল্প জীবিকায়নের লক্ষে আইডিএফ’র সহযোগিতা নিয়ে আমরা তরমুজসহ নানা ধরণের সবজি চাষে ঝুকছি। কেননা স্থানীয় ভাবে যেমন এর চাহিদা আছে তেমনি দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়রা এসে উৎপাদিত শাক-সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি স্থানীয় কৃষক বেশ লাভবান হবেন।
এ বিষয়ে হালদা প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও আইডিএফ’র মৎস কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। হালদকে বাচাতে বা এর মৎস্য উৎপাদনকে বৃদ্ধি করতে সরকারি ভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে হালদাকে ‘বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। হালদা আমাদের সম্পদ। তাই এটিকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা ২০১৮ সাল থেকে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর পিএসিই প্রকল্পের অর্থায়নে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) হালদা নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও মিঠা পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরনের লক্ষে হালদা’র উজান মানিকছড়ির বিভিন্ন অংশের তামাক চাষীদের বিকল্প জীবিকায়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে বিগত কয়েক বছর যাবৎ উপজেলার বাটনাতলী, গোরখানা, যোগ্যাছোলা, আছাদতলী এলাকার তামাক চাষীরা বিকল্প জীবিকায়ন চাষাবাদ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি। তাদেরকে আধুনিক কৃষি চাষাবাদের উপর উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তাদের মাঝে সবজি বীজ, মাছের পোনা, মুরগীর বাচ্চা, উন্নত প্রজাতির পেঁপে, আম, কাঁঠাল, শরিফাসহ বিদেশি ফল রামবুটান ও ড্রাগনে চারা বিতরণ করা হয়েছে।
মানিকছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ হাসিনুর রহমান জানান, হালদার উজান মানিকছড়ির বাটনাতলী ও যোগ্যাছোলা ইউনিয়নের কিছু অংশে ক্ষতিকর তামাক চাষাবাদ হচ্ছিন বেশ কয়েক বছর ধরে। যা উপজেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও আইডিএফ’র সহযোগিতায় অনেকটা কমে আসছে। সেখানকার স্থানীয় কৃষকদের তামাক ছেড়ে বিকল্প জীবিকায়নের লক্ষে শাক-সবজি চাষাবাদের নানা পরামর্শ দিয়ে আসছেন কৃষি বিভাগের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তারা। তাদের পরামর্শে ও আইডিএফ’র সহযোগিতায় ইতোমধ্যে সেখানে বারোমাসি তরমুজ চাষাবাদ হচ্ছে সেখানে। এতে কৃষকরা বেশ লাভাবান হবেন। এছাড়াও কয়েক বছরের মধ্যে সেখান থেকে তামাকের চাষাবাদ শূণ্যের কোটায় নেমে আসবে বলেও তিনি মনে করছেন।