উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ইউরোপে যাচ্ছে কৃষক পিতার কৃতী ফুটবলার সেনারী চাকমা
॥ খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি ॥
খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত অবহেলিত এলাকার কৃষক পিতার কৃতী ফুটবলার আনুচিং-আনাই মগিনী ও মনিকা চাকমার পর আরেক নক্ষত্রের নাম সেনারী চাকমা। ফুটবলে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ইউরোপে যাচ্ছে তিনি। বান মোহন চাকমা ও কনিকা চাকমা দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সেনারী চাকমা (১৭)। তিন ভাইয়ের পর জন্ম তার। অভাবের সংসারের জন্ম তার। সংসারে কেউ নেই শক্ত হাতে হাল ধরার। অনেক কষ্টের মাঝে গ্রামে বেড়ে উঠা। তিন ছেলেও দিন মজুরির কাজ করে সংসার চালান। প্রতিনিয়ত অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করে তিন বেলা খাবার যেখানে অনিশ্চিত সেখানে সেনারী চাকমার ফুটবল খেলা বিলাসিতারই শামিল। এত কষ্টের সংসার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিজেকে চেনাচ্ছেন সেনারী। কখনো ভাবতেও পারেননি এই অবস্থানে আসবেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে ফুটবলে হাতেখড়ি সেনারী চাকমার। এরপর বয়সভিত্তিক প্রমীলা ফুটবলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করে ফুটবল জীবনের বাঁকবদল ঘটান খাগড়াছড়ির পেরাছড়ার দুর্গম জনপদে বেড়ে ওঠা সেনারী চাকমা। প্রাথমিকভাবে সারাদেশ থেকে ৪০ জনকে বাছাই করে বিকেএসপিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ইউরোপে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ১৬ জনকে নির্বাচিত করা হয়। খাগড়াছড়ির সেনারী চাকমা তাদেরই একজন। এমন খবরে প্রতিনিয়ত অভাবের সঙ্গে লড়াই করা সেনারী চাকমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। সেনারীর পরিবার ও তার খেলাধুলার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
সেনারী চাকমা বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে সেই ছোট বেলা থেকে খেলতাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিল খেলার মাধ্যমে ভালো কিছু করবো। কিন্তু বাবা-মায়ের অভাবের সংসার হওয়ার কারণে ইচ্ছে পূরণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। পরিবারের সবাই দিনমজুরি কাজ করে। তাই আমার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে আবার খেলার জন্য খরচ করা সম্ভব ছিল না। ২০১৯ সালে যখন চেঙ্গী একাডেমিতে ভর্তি হই তখন স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া দিতে অনেক কষ্ট হতো মায়ের। প্রায় ৩কিঃমিঃ পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে খেলাও সম্ভব ছিল না।
সেনারী আরও বলেন, আমি এখন ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আশাকরি ভালো কিছু করতে পারবো। আমার পরিবারের অভাব দূর হলে আমি অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবো। দেশের এবং এলাকার সম্মান বৃদ্ধি করতে নিজের মেধা এবং শ্রম কাজে লাগাবো। আমার ভবিষ্যত নিয়ে সবার কাছে দোয়া চাই।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক ও সেনারী চাকমার ফুটবল কোচ ক্যহ্লাসাই চৌধুরী জানান, ২০১৯ সালে সেনারী চাকমা আমার চেঙ্গী ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হয় । এরপর থেকেই তার প্রতিভা দেখে আমি তাকে সবসময় পরামর্শ দিতাম যেন সে আরও অনেক ভালো করতে পারে। তারই ধারাবাহিকতা সে সবসময় খুব চেষ্টা করতো ভালো কিছু পাওয়ার আসায়। তার যে প্রতিভা আছে আমার বিশ্বাস সে ইউরোপ থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে আসলে জাতীয় দলে সুযোগ পাবে। দেশ এবং জেলার সম্মান রক্ষার্থে নিজের মেধা ও প্রতিভা কাজে লাগাবে।
প্রতিভাবান এ ফুটবলার ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সেনারি চাকমার অনূর্ধ্ব ১৭ নারী ফুটবলে খাগড়াছড়ি জেলা দলের এটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছে। সারা দেশ থেকে এই বয়সী ৪০ জন সেরা ফুটবলার বাছাই করে বিকেএসপিতে ২ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে মাত্র ১৬ জনকে ইউরোপে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। সে আমাদের জেলার গর্ব। পাহাড়ের গর্ব। আমরা সকলে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে সে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। পাহাড়ের আনাচে-কানাচে সেনারী চাকমার মতো যেসব প্রতিভাবান আছে, আমরা যদি তাদের লালন না করি তবে এসব প্রতিভার বিকাশ ঘটবে না।