প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীদের কষ্ট সীমাহীন
রাঙ্গামাটির বরকলে তিন বছর ধরে অচল স্বাস্থ্য বিভাগের নৌ-অ্যাম্বুলেন্স
॥ নিরত বরন চাকমা, বরকল ॥
দীর্ঘদিন ধরে বরকল উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের নৌ-অ্যাম্বুলেন্স এর সেবা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন রোগীরা। উপজেলার ৫ ইউনিয়নের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবার জন্য বরকল সদরে একটি মাত্র সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। মুমূর্ষ রোগী কিংবা সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা সেবা পেতে পাহাড়-নদী বেয়ে আসতে হয় বরকল সদর হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবার অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ায় হাসপাতালে এসে হতাশ হয়ে পড়েন রোগীর স্বজনরা।
দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোগীরা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা দায় এড়াতে নামমাত্র রোগীদের সেবা দেন। অনেক সময় প্রাথমিক সেবা না দিয়ে সরাসরি জেলা সদর হাসপাতালে অথবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেন। রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য ছোট নৌকা অথবা যাত্রীবাহী দ্রুতযান (স্পিডবোট) ভাড়া করে নিয়ে যাচ্ছেন। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তারা ঝুঁকি নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় আসা রোগীদের জন্য অনেকটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের নৌ-অ্যাম্বুলেন্স থাকা স্বত্বেও রোগীর সেবার কাজে ব্যবহার হয় না। এক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার চাকমার সময়কালে মুমূর্ষু রোগীদের জরুরি সেবার জন্য জেলা পরিষদ থেকে নৌ-বোট অ্যাম্বুলেন্স উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়। যাবতীয় অর্থ সহায়তা ইউএনডিপি’র মাধ্যমে দেয়া হতো। পরবর্তী ২০১৫ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে চালকের বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স সেবাও বন্ধ হয়ে যায়।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন প্রেম মালা চাকমা জানান, গত মাসে ছেলের বউ হঠাৎ অসুস্থ হয়। তৎক্ষনাৎ বরকল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বিবেচনা না করেই রাঙ্গামাটি প্রেরণ করেন। ৪ হাজার টাকা ধার নিয়ে স্পীড বোট ভাড়া করে রোগীকে নিয়ে যান। অথচ নৌ-অ্যাম্বুলেন্স ঘাটে বাঁধা অবস্থায় পড়েই আছে। এসব সমস্যারমূলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী বলে তিনি অভিযোগ করেন।
নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালক নতুন বিকাশ চাকমা জানান, ২০১৪ সালে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ কর্তৃক নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বেতন-ভাতা সবকিছু ইউএনডিপি’র অর্থায়নে চলতো। এরপর বছর যেতে না যেতে ইউএনডিপি’র প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। ২০১৫ সালে বরকলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দূরাবস্থা কথা ভেবে রোগী পরিবহনের জন্য নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি পুনরায় ফেরত পাওয়ার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর গণস্বাক্ষরে আবেদপত্র দাখিল করেন। আবেদন পত্র দাখিলের তিন মাস পর ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদের পক্ষে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শকুন্তলা চাকমা নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি গ্রহণ করেন। কিন্তু নৌ- অ্যাম্বুলেন্সটি আনার পর রোগীদের সেবায় কাজে আসেনি। তিনি আরো জানান, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং গর্ভবতী মা’য়েদের সেবার জন্য নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের যাবতীয় বরাদ্দ দিতেন ইউএনডিপি। কিন্তু ইউএনডিপি প্রকল্প শেষ হওয়ায় সে সুবিধাও বন্ধ হয়ে যায়। রোগীদের সুবিধার জন্য জেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিল থেকে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালকের জন্য ৫০% বেতন প্রদানের সক্ষমতা যাচাইয়ে ৩ নভেম্বর ২০১৬ সালে উপজেলা পরিষদকে প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু সেসব ব্যবস্থারও কোন গতি নেই। সাড়ে তিন লাখ টাকা ভাতা প্রাপ্য রয়েছেন বলে দাবি জানান নতুন বিকাশ।
বরকল ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাত কুমার চাকমা জানান, জনগণের সেবার জন্য নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি জেলা পরিষদ দিয়েছিল নানান কারনে এখন রোগীদের সেবায় কাজে আসছে না। বরকল ইউপি সদস্য মোঃ আবু বক্কর জানান, নৌ- অ্যাম্বুলেন্স দীর্ঘদিন ধরে রোগীর কাজে আসছে না। জ্বালানি খরচ বেশী তাই সরকারি বরাদ্দও নেই। তিনি আরো জানান, নৌ- অ্যাম্বুলেন্সটি দীর্ঘদিন অচল থাকায় ইঞ্জিনও নষ্ট হয়। মেরামতের জন্য রাঙ্গামাটি পাঠানো হয়েছে। নৌ- অ্যাম্বুলেন্স সেবা অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মংক্যছিং সাগর এর সাথে ফোনে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটি থাকায় নৌ-অ্যাম্বুলেন্স রোগীর কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। তাছাড়া সরকারিভাবে জ্বালানী ও চালকের জন্য ভাতা বরাদ্দ নেই।
এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিধান চাকমা জানান, নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার চাকমার সময়কালে জেলা পরিষদ থেকে বরকল উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়। অর্থায়নে সহযোগিতা করতেন ইউএনডিপি। নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের চালকও ইউএনডিপির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে চালকের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। রাজস্ব আয় না থাকায় উপজেলা পরিষদ থেকেও বেতন ভাতা দেয়া সম্ভব না। ২০১৫ সালে জেলা পরিষদে সেটি হস্তান্তর করা হয়। পরে নৌ-অ্যা¤ু^লেন্স প্রয়োজন পড়ায় তারা আবার উপজেলা পরিষদকে হস্তান্তর করেন। কিন্তু রোগীদের স্বার্থে এটির চালুকরণ জরুরী বলে তিনি উল্লেখ করেন।