পাহাড়েও কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা
লামায় ৬৫ একর জমিতে ২৯ হাজার ৭৭৫টি কফি গাছ রোপন
॥ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,লামা ॥
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে এক কাপ গরম চা কিংবা কফি শরীর ও মনকে নিমিষেই চাঙা করে তোলে। দেশে চায়ের পাশাপাশি কফির প্রতি মানুষের দুর্বলতা অনেক বেড়েছে। সেই কারণে দেশেও কফির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি পাহাড়ে এখন ব্যাপকভাবে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, এদেশে চা চাষের ইতিহাস সুদীর্ঘ হলেও কফি চাষ খুব বেশি দিনের নয়। গত কয়েক বছরে পাহাড়ে স্বপ্ল পরিসরে চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। চা চাষের সফলতার পর এবার কফি চাষের ভালো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। দেশের তিন পার্বত্য জেলাগুলোয় বেশকিছু জায়গায় কফি বাগান গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোমী ও আগ্রহী কৃষকের হাত ধরে পাহাড়ে কফি চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রথমে সখ করে দু একজন কফি চারা রোপন করলেও এখন অনেকে বাণিজ্যিকভাবে রোপন করছে কফি চারা।
এদেরই একজন লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের ব্রীকফিল্ড এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (প্রাথমিক) প্রমোদ চন্দ্র বড়ুয়া। তার বাগান ঘুরে দেখা যায় তার সৃজিত ফলজ বাগানের ভিতর ২ একর জায়গায় ১২২৫টি কফি চারা লাগিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে লামায় প্রত্যেক ইউনিয়নে পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে কফি চাষ। এ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিমালিকানায় প্রায় ৬৫ একর জায়গাজুড়ে ২৯৭৭৫টি কফি গাছ লাগানো হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে ২০১৮-২১সাল পর্যন্ত ৭ জন কৃষক, বাণিজ্যিকভাবে ২০২১ সালে ৬৬ জন কৃষক কফি চাষ করে। হর্টিকালচার ও ডিএই এর মাধ্যমে ৬৬ জন কৃষককে চারা, সার, নেট ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২.৫ একর করে ৫টি বাণিজ্যিক ও ৫০ শতক করে ৫০টি কফিজাত প্রযুক্তি প্রদশনী দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি অফিস।
এদিকে দু একটি কফি বাগান ঘুরে দেখা যায় কোথাও সারিবদ্ধভাবে, কোথাও গাছের ফাঁকে ফাঁকে এবং কোথাও পাহাড়ের উঁচুনিচু ঢালুতে কফি চারা লাগানো হয়েছে। কোথাও গাছ ৩ থেকে ৪ফুট লম্বা আবার কোথাও বয়স এক সপ্তাহ হতে এক মাস হয়েছে। কোন কোন গাছে ফল আসতেও দেখা যায়। তবে তা পরিপক্ব হয়নি এখনও। ঝাঁকড়ানো সবুজ পাতা আর ফলন ইঙ্গিত করছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে একদিন অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনার নব দিগন্ত হবে কফি চাষ।একই ইউনিয়নের আখিরাম পাড়ায় আরেকটি বাগান ঘুরে দেখা যায় ৪ থেকে ৫ ফুট লম্বা হয়েছে কফি গাছ। কয়েকটি গাছে ফলও এসেছে। নতুন উদ্যোক্তা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাথোয়াইচিং মার্মা জানান, প্রথমে তিনি আম বাগান সৃজন করলে তা দেখে অনেকে আম বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তেমনি কফি চাষের উজ্জল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে কফি চাষে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে ৪ হাজার কফি চারা লাগান তিনি।
এ্যাসোসিয়েশন অব ড্যাবটিস্টের কফি এক্সপার্ট প্রশিক্ষক তৈদরাম ত্রিপুরা বলেন, একটি কফি চারার মূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এই গাছ ৭০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বাঁচে ও ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। এরপর ঢালপাল ছেটে মার্তৃগাছের একফুট উপর থেকে তির্ডকভাবে কেটে দিলে পুণরায় ফলন পাওয়া যায়। ১টি গাছ প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ কেজি ফলন দেয়। এর বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। কফি চাষীদের জন্য সুখবর হচ্ছে দেশীয় ও বিশ্ববাজারে কফির মূল্য একই থাকে। ফলে এর কোন সিন্ডিকেট থাকেনা। দেশে একমাত্র কফি বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নর্দান এন্ড কফি রোষ্টার কোম্পানী।
উপজেলায় প্রথম উদ্যোক্তা তৈদুরাম প্রধমে ৩ একর জায়গায় সাড়ে তিন হাজার পরে ১২ হাজার কফি চারা লাগান তিনি। তার চারার বয়স ৪ বছর হয়েছে। ৩ বছরের মাথায় কিছু কিছু গাছে ফলন আসে। আবাদি অনাবাদি দুটোতেই কফি চাষ করা যায়। কফি ছায়া সহনীয় গাছ বিধায় চাষীদের জন্য সুবিধা হচ্ছে কফি বাগানের ভিতর অন্যান্য বাগান কিংবা অন্যান্য বাগানের ভিতর কফি বাগান করা যায়। ফলে অন্যান্য চাষের চেয়ে কফি চাষে কৃষকের লাভের সম্ভাবনা বেশি।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র বর্মন বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধিনে কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন করায় দেশে কফি চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কফি চাষের দুই তৃতীয়াশ চাষ হয় পার্বত্য অঞ্চলে। বান্দরবান জেলাসহ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জেলায় আগে থেকে কফি চাষ থাকলেও এত বেশি সাড়া মিলেনি। অধিদপ্তরের উদ্যোগের কারনে প্রকল্পের আওতায় কফিচাষে দিনদিন আগ্রহী হয়ে উঠছে কৃষকরা। প্রকল্পের আওতায় দুই অর্থ বছরে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ১১৫৬৫টি চারাসহ সার, নেট, নগদ অর্থ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে কৃষকদের মাঝে।