আলীকদমে সরকারি আদেশ অমান্য করে নদী ও ঝিরির ধারে তামাক চাষ
॥ সুশান্ত কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাঁ, আলীকদম ॥
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ। এক সময় ধান, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদের জন্য সুনাম ছিল আলীকদম উপজেলা। এখন আলীকদম উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে দেখা যায় নদীর ধারে ও ঝিরিসমূহের ধারে তামাক চাষ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে নদীর ধারে নদী কিংবা ঝিরি জলধারে থেকে ৬০ ফুট মধ্যে তামাক চাষ না করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ বেশ কিছু এলাকায় তামাক চাষ নদীর ধারে এবং পাহাড়ী ঝিরিতে তামাত চাষ করা হয়েছে।এদিকে তামাক নির্মূল অভিযান পরিচালনা করা হলেও দুই-তিন বছর ধরে তা স্তিমিত রয়েছে। এ কারণে নদীর পাশে ও পাহাড়ী ঝিরি গুলোর ২ ধারে বেড়ে চলেছে তামাক চাষ।
উৎপাদিত তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে তন্দুর (চুল্লি)তামাক পোড়ানোর চুল্লি। এসব চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনের কাঠ। স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে লাখ লাখ মন কাঠ ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে আলীকদমে বৃক্ষশুন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি হেক্টর জমিতে সাধারণত ৭০ বেল (এক বেল সমান ৪০ কেজি) তামাক পাতা উৎপাদন হয়। চলতি বছরে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হতে পারে ১৭ লাখ ৫০ হাজার বেল পাতা।
উৎপাদিত পাতা পোড়ানো হয় তন্দুল নামে পরিচিত চুল্লিতে। আর প্রতি ৭০ বেল তামাক পোড়াতে প্রয়োজন হয় চার টন জ্বালানি। প্রতি বছর তামাক পোড়াতে ব্যবহার হচ্ছে ১ লাখ টন বন থেকে সংগৃহীত জ্বালানি কাঠ।
আলীকদমে ফসলি জমি ছাড়াও তামাকের আগ্রাসন থেকে বাদ পড়েনি স্কুলের মাঠ, মাতামুহুরী নদীর চর, চৈক্ষ্যং খালের চর, রোয়াম্ভু ঝিরি,কলার ঝিরি, বাঘের ঝিরি, গয়াম ঝিরি, ১নং পূর্ণবাস এলাকার ঝিরিসহ বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ী ঝিরি ও ছড়া গুলোতে তামাক চাষ হচ্ছে। এইসব জলধারে তামাক চাষের কারণে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি ও ঝিরিগুলোর পানি। এইসব পানি ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে স্হানীয় জনসাধারণ।
আলিকদম উপজেলার নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাংতাই হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মং চিং হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ এবং চৈক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের পাশে গড়ে উঠেছে তামাকের বাগান। এর বাইরেও অনেক সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আছে একরের পর একর তামাকের বিশাল বাগান।
এদিকে চাষিদের যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে সজাগ থাকেন তামাক প্রতিষ্ঠান চাষিদের সুবিধার জন্য আবুল খায়ের ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো ও ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে আলীকদমে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন তামাকি চাষীদের সাথে কথা হলে তারা জানিয়েছেন, তামাক ফসল চাষের শুরুতে তারা অর্থসংকটে ভোগেন। এ সুযোগে তামাক প্রতিষ্ঠানগুলো চাষিদের মধ্যে কার্ড দিয়ে বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করে এবং কোনও শর্ত ছাড়াই ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেয়। সেই সঙ্গে প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন তারা। তামাক কেনার শতভাগ নিশ্চয়তাও পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে।
এ বিষয়ে আলীকদম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্বল দাশের সাথের কথা হলে তিনি বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু চাষিরা অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।
চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের কলার ঝিরি এলাকার চাষি শাহ আলম জানান, সবজি চাষে খরচের তুলনায় মুনাফা কম, কিন্তু তামাক চাষে মুনাফা বেশি। তাই দিন দিন তামাক চাষির সংখ্যা বাড়ছে। তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় নারী ও শিশু-কিশোরসহ পরিবারের সবাই সমানভাবে কাজ করছেন তামাক ক্ষেতে।
আরও জানা গেছে, দিনভর তামাক ক্ষেতে কাজ করে নারী শ্রমিকরা মজুরি পায় মাত্র ৩০০ টাকা। বিকল্প কোনও কর্মসংস্থান না থাকায় অল্প বেতনে তামাক ক্ষেতেই কাজ করতে হচ্ছে তাদের। তামাক পরিচর্যা করার সময় মাঝে মধ্যে পাতার বিষাক্ত গ্যাসে তাদের বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘোরে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।