[vc_row][vc_column css=”.vc_custom_1596871563159{margin-bottom: 0px !important;}”][vc_column_text css=”.vc_custom_1596874329023{padding-top: -30px !important;}”]

শিরোনাম
দীঘিনালায় যৌথবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ কর্মী আটকবান্দরবানে রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবন জোড়পূর্বক দখলের অভিযোগবান্দরবানের থানচিতে ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশমানিকছড়িতে চাঁদাবাজি করতে এসে জনতার হাতে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী আটকবরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগরাঙ্গামাটির লংগদুতে নৌকার কিছু নেতাকর্মী এখন ট্রাকে উঠে গেছেকাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টাসড়ক দুর্ঘটনায় কাপ্তাই বিএফআইডিসি এলপিসি শাখার কর্মচারী নিহতমানিকছড়ির নবাগত ইউএনও’র সাথে বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের শুভেচ্ছা বিনিময়খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
[/vc_column_text][/vc_column][/vc_row]

গল্পের আড্ডা, আড্ডার গল্প

২২৮

॥ সুমিত্র চাকমা ॥

আমরা আড্ডা দিই। দেদার আড্ডা দিই, রোজ। আড্ডার রকমফেরও আছে। নানা প্রাসঙ্গিকতার সূত্র ধরে অবলীলায় তরঙ্গায়িত হয় আড্ডার সজীবতা। ধরুন, এলাকায় একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল এবং তা পরের দিন হয়তো পত্রিকায় স্থান পেল, হয়তো নয়। এরপর চা’য়ের দোকানে তুমুল ঝড়-তুফান। এমন ঘটনা অতি সাধারণ। এটিকে আমরা অভিহিত করি চা’য়ের দোকানের আড্ডা। এমনকি আমেরিকায় নির্বাচন হবে, কোথাও খেলাধূলা হবে, কিংবা ক্রিকেটের গল্প, ভ্রমন বর্ণনা, রাজনীতি, নায়ক-নায়িকাদের অভিনয়-এসবই উত্তাপ ছড়ায় ঐ আড্ডাস্থলে। বিষয় ও ব্যাপ্তি নানাভাবে বাঁকবদল করে আমাদের আড্ডায়, আলাপচারিতায়। আমি ভীষণ আড্ডাপ্রিয় বটে। তবে কে আড্ডা দিতে অপছন্দ করেন? তরুন, যুবা, বৃদ্ধ – কে না চায় আড্ডায় সময় দিতে? আপনি কর্মস্থল থেকে ফিরে এসে অথবা আপনার প্রাত্যহিক কর্ম সম্পাদন করে একটা মোক্ষম বিনোদনের উপায় হিসেবে মনে মনে ঠিক করে ফেললেন চা’য়ের দোকানে এক কাপ চা’য়ের চুমুক দেবেন। অথবা, অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা, দরকারি কথাবার্তা আছে-তবে চলি চা খাই, এ-ই তো। এভাবে গল্প, আলোচনা, হাসি, ফুর্তি ইত্যাদি অনুঘটকে ব্যঞ্জনাময় হয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রাণোচ্ছ্বল মুহূর্তগুলো। আপনি ঘরের বাইরে কোথাও যাবেন না, কারও সাথে মিশবেনও না-তা কি কল্পনা করা যায়? করোনাকালীন বিশ্বের প্রচলিত ‘লকডাউন’ বা ‘কোয়ারেনটাইন’ নামক শব্দগুলোই তো বুঝিয়ে দিল যে আমরা কতটা বিচ্ছিন্ন বা নিস্তরঙ্গ জীবন-যাপনে সক্ষম। বাঙালির অভ্যাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে কে যেন বলেছিলেন যে, দেশ-বিদেশে বাঙালির রমরমার পেছনে আছে সকালের লুচি, দুপুরের ঘুম আর বিকেলের আড্ডা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মুখর আড্ডা শিক্ষক শিক্ষার্থিদের একটি প্রাণরসায়নের নাম। রোজ ছাত্র-শিক্ষকগণ বসতেন, আড্ডা জমাতেন, আলোচনা করতেন; তর্ক হতো, বিনোদনও। শানিত কথার খই ফোটানো মেধাবি শিক্ষার্থিদের ‘ঝলসানি লাগা সতেজ ভাষণ’ শুনে প্রতিটি শিক্ষার্থি যে মননের সম্মোহনী চেতনায় দীপ্ত হতে পারেন তা নিঃসন্দেহে বলা না গেলেও অন্তত অনুমান করা চলে। কেবল মধুর ক্যান্টিন বা টিএসসি নয়; রঙবেরঙের আলোক রশ্মির সম্মিলিত বিচ্ছুরণ দিয়ে শিক্ষার্থির হৃদয়াকাশে যদি রঙধনুর প্রদীপ্ত আভা বিচ্ছুরিত না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অর্থ থাকতো কিনা সন্দেহ। তাই অনেকে বলেন, আড্ডাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। ষাট থেকে সত্তরের দশক ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্নিগর্ভ দশক। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তাল সময়ের দিনগুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের আড্ডার স্ফুটনোন্মুখ প্রলয়শিখা বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতিটি এলাকাজুড়ে যে ঝলকানি দিয়েছে-সেসব ইতিহাস পড়লে এখনও গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। কখনো রোমাঞ্চকর অথচ গৌরবগাঁথায় সমৃদ্ধ সেই মধুর ক্যান্টিন, আড্ডা, মিলনমেলা।

বাঙালির আড্ডার আঁতুরঘরে আরও যোগ করা যেতে পারে ঢাকার সেই বিখ্যাত ‘বিউটি বোর্ডিং’ এর কথা। তিরিশের কিংবা পঞ্চাশের দশকের কবি সাহিত্যিকদের লেখা থেকে জানা যায় কত সৌরভে গৌরবে মুখরিত ছিল এ বোর্ডিং! কবি শামসুর রাহমান তাঁর স্মৃতিকথায় বহুবার বিধৃত করেছেন সেই ‘বিউটি বোর্ডিং’ এর কথা। শিল্প-সংস্কৃতির খ্যাতিমান বোদ্ধা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সঙ্গীতশিল্পীসহ কার পদধূলি পড়েনি এ চরাচরে ! শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ শিল্পী কবিদের মননচর্চার চারণভূমি ছিল এ বোর্ডিং। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত জমজমাট আড্ডার পরিসর থেকে বেরিয়ে আসত কবিতা পাঠ, গল্পবলা, উপস্থাপনা, সাহিত্যের নানা শাখার নানা অনুষঙ্গ। দেশবরেণ্য বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অমূল্য প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটত এ আড্ডাস্থল থেকে। একের পর এক তুফান তোলা বাক্যবানে তাঁরা যেমন সমৃদ্ধ হতেন, তেমনি এ আড্ডাস্থল থেকে আবহমান বাংলার সমাজ সংস্কৃতির বাঁকবদলের গতিপথ প্রবাহিত হয়েছে এক একটা উদ্দিষ্ট সন্নিধানে। বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথা থেকে অন্তত এ তথ্য পাওয়া যায়। আড্ডা যেমন বিনোদনের স্থান, তেমনি সামাজিকতারও। বিকেলে অফিস ফেরত লোকের চা’য়ের চুমুকের অন্যরকম আড্ডা বা বাড়িতে খোশগল্পে মেতে গানের নির্ভেজাল আড্ডায় কেউ যদি আমন্ত্রিত হন তবে তিনি কোনভাবেই তা হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কেননা এখানে যে আনন্দে মেতে থাকার ঘোর তার হিস্যা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন।

চলুন, তবে আরও কলকাতার কফি হাউসের আড্ডায়। মান্না দে’র বিখ্যাত ‘কপি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটিতেই প্রাণময় সৌরভ ছড়িয়ে আছে সেই কপি হাউসের। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কপি হাউস ছিল আড্ডার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি নানা মত ও চরিত্রের মানুষদের মধ্যেকার মেলবন্ধনের অবিমিশ্র চঞ্চলতায় গম্গম্ করতো ঐ কপি হাউজ। নিশীথ ভড়, সমরেন্দ্র দাস, অরণি বসু, অমিতাভ গুপ্ত, তুষার চৌধুরী মতো কবিদের উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠতো কপি হাউসের আস্তানা। আর গল্পকারদের আড্ডার প্রধান ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। তার বিষয় উপস্থাপন, কথা বলার ভঙ্গি শ্রোতাদের চুম্বকের মতো টানতো। আরও আসতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । সত্যজিৎ রায়ের গল্পের কাহিনীকার হিসেবে, আধুনিক বাংলা কবিতার তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘কৃত্তিবাস’ আন্দোলনের নেতা এবং আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠানের উঠতি লেখক হিসেবে তখন সুনীল কফি হাউজের মেগাস্টার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অনেক কবি, সাহিত্যিক শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর সে সময় এই কফি হাউজ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের আর এক শিবির, অন্যরকম এক ঘাঁটি। আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরি, আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ লেখক এই কফি হাউজে সে সময় নিত্য যাতায়াত করতেন। আড্ডা অবশ্যই অবসরের খোরাক হওয়া উচিত। কিন্তু, এজন্য অকারণে সারাক্ষণ ব্যস্ত হওয়া খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে। বিশ্বের সৃজনশীল মানুষের সকলেই যে বেশি আড্ডায় মেতে থাকতেন তা নয়। বরঞ্চ, তাঁরা অনেকেই নির্জনতাকে বেছে নিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাই নির্জন প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার কথা বলেছেন। এই তো গেল এক ধরণের আড্ডার হিসাব। আমি শুরুতে চা’য়ের দোকানের আড্ডার কথা বলেছি। তবে রকমারি আড্ডার কথা বলা হয়নি। মদের আড্ডা, জুয়ার আড্ডা, বিবাহ মজলিশের আড্ডা ইত্যাদি আরও কত কি। সব আড্ডার ফসল যে সব সময় ভাল – তা নয়। মানুষের চরিত্রভ্রষ্টের জন্যও এ সংস্কৃতিকে দায়ি করা যায় বটে কিন্তু তার জন্য তো আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বা পারিবারিক নর্মটাও নির্ভর করে। ঢালাওভাবে আড্ডার নেতিবাচক দিকটাকে প্রাধান্য দিলে তো আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা থেকে শুরু করে অন্যান্য সবকিছুকেও বাদ দিতে হবে। কারণ, পৃথিবীর সবকিছুর ইতি-নেতি আছে। আপনি বাঁশটাকে বাঁশ হিসেবে রাখতে পারেন, আবার তা দিয়ে বাঁশিও বানাতে পারেন, লাঠিও বানাতে পারেন যা সর্বোতভাবে আপন ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। মানুষের চলাফেরা কিংবা বিনোদনের নানা অনুষঙ্গসহ হাসি, আলাপ, খুনসুটি, শোনা, বলা কতকিছুর মাধ্যমে সজীবতা পায় আড্ডাস্থল। সক্রেটিস সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি ছিলেন ভীষণ আড্ডাপ্রিয়। এক লোক রোজ সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পথ হেঁটে তাঁর আড্ডাস্থলে উপস্থিত হতেন তাঁকে দেখার জন্য, তাঁর কথা শোনার জন্য। সক্রেটিসের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতেন, সমৃদ্ধ হতেন এবং মানুষকে বলতেন। কারন, একজন জ্ঞানতাপসের আলাপচারিতায় যুক্ত হওয়া মানে তো নিজের পৃথিবীকে আবিষ্কার করতে শেখা। সক্রেটিস সবার প্রশ্ন শুনতেন। তারপর একে একে উত্তর দিতেন। এভাবে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তিনি তাঁর দর্শন শোনাতেন। উল্লেখ্য, তাঁর জ্ঞান আর দর্শনের প্রখরতায় সক্রেটিসই ছিলেন ঐ আড্ডার নায়ক। এভাবে, প্রতিটি আড্ডায় কিন্তু একজন মধ্যমণি থাকে। বুদ্ধিদীপ্ত নন্দন মনন সমৃদ্ধ টাওয়ারিং ফিগার স্বভাবতই এ আসন অলঙ্কৃত করতে পারেন। বিনাভোটে যেন তাঁর জয়জয়কার। তবে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, তাঁর আপন আলোয় তিনি এ পদে শোভিত হন। স্বার্থপর, মেজাজি ব্যক্তি আড্ডাস্থলে ঠিকতে পারেন না। চিন্তা ও মননের ঐক্য না হলে আড্ডা জমেনা। দেখা যাবে যে শিল্প সাহিত্যের বেশিরভাগ সৃষ্টিও ঐ আড্ডা থেকে। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলেছেন,”আমি উপন্যাসের রসদ পাই আড্ডা থেকে”। আর নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, “আড্ডা ছাড়া আমার একদিনও চলেনা”।

আড্ডা যেমন বিনোদনের একটি জায়গা, তেমনি আড্ডাস্থল থেকে বেরিয়ে আসে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, অজানা তথ্য। আড্ডায় নির্দিষ্ট কোন সাবজেক্ট থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলমান অথবা অতীতের কোন হালনাগাদ তথ্য বেরিয়ে আছে। চা’য়ের দোকানের আড্ডা দিয়ে শুরু করেছি, শেষ করতে চাই চায়ের দোকানের আড্ডা দিয়ে। ব্রিটিশরা চা খাওয়াটা শিখিয়ে গেছে। প্রকারান্তরে চা’য়ের আড্ডাটাও দিয়ে গেছে। তাই চা’য়ের কাপে এখনো প্রতিনিয়ত ঝড় হয়, কখনো তুফানও। তা হোক, হতে পারে। তবে, অন্য আড্ডায় না গিয়ে আজকের আড্ডাটা বরং এখানেই মুলতবি করি।

লেখকঃ প্রধান শিক্ষক, শিলকাটাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লংগদু, রাঙ্গামাটি।